খরার গ্রাসে কৃষি, প্রাণ-প্রকৃতি

কোলাজ
জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৫ | ০১:১৫ | আপডেট: ১৭ জুন ২০২৫ | ০৯:০১
রাজশাহী অঞ্চলে গত ৫ বছরে আষাঢ় ছিল বৃষ্টিহীন। আমন ধানের জমি পানিতে ভরত না। খরায় জমি ফেটে চৌচির হয়ে যেত। পুড়ে যেত পাট ও গ্রীষ্মকালীন ভুট্টাক্ষেত। শুধু রাজশাহী নয়, দেশের ২২টি জেলা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন খরার কবলে পড়ে।
বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, লবণাক্ততাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে কয়েক বছর ধরে নতুন করে যোগ দিয়েছে খরা। ধীরে ধীরে এ দুর্যোগ শুধু কৃষি উৎপাদন নয়– খাদ্য নিরাপত্তা, জীবনযাত্রা, পরিবেশ, পানিসম্পদ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ জাতীয় পর্যায়ে এখনও খরাকে স্বতন্ত্র দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস। এ বিষয়ে বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তুলতে প্রতিবছর ১৭ জুন পালন করা হয় দিবসটি। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ভূমি পুনরুদ্ধার করো, সম্ভাবনার দুয়ার খোলো’।
মরুকরণ, খরা ও জমির উর্বরতা কমার বিষয়টি সংকট হিসেবে বৈশ্বিক হলেও দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে বাংলাদেশে এটি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতি উষ্ণতা দেশের সব অঞ্চলকে ক্রমশ ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা জানায়, পৃথিবীতে খরার কারণে যেসব মৃত্যু হয়, তার প্রায় ৯০ শতাংশ উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোতে। বাংলাদেশও এই ঝুঁকির শীর্ষে আছে। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ ১৩ বার খরায় আক্রান্ত হয়েছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) গবেষণা বলছে, খরার ঝুঁকিতে রয়েছে ২২টি জেলা। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, জয়পুরহাট, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ রয়েছে। খুলনা বিভাগের মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা এবং ঢাকা বিভাগের গাজীপুর। খরার সঙ্গে বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও কুষ্টিয়া। খরার সঙ্গে হঠাৎ বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি।
খরায় দেখা দেয় সুপেয় পানির সংকট, কৃষিকাজে ব্যবহৃত পানির ঘাটতি; মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পায় এবং ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে।
রাজশাহীর পদ্মা একসময় খরস্রোতা ছিল। আজ তা ধু-ধু বালুচর। একসময় যেখানে শত শত জেলে মাছ ধরতেন, এখন সেখানে বালু। বিশেষজ্ঞরা এর কারণ হিসেবে পদ্মা নদীর জলপ্রবাহ এবং পানির স্তর কমাকে চিহ্নিত করেছেন। বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের সাতজন গবেষক রাজশাহীতে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন, যা স্প্রিঙ্গার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ১৯৭৪ সালে পদ্মায় শুষ্ক মৌসুমে প্রতি সেকেন্ডে পানিপ্রবাহ ছিল ৩ হাজার ৬৮৫ ঘনমিটার। ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ উদ্বোধন করা হয়। এ কারণে ২০২৪ সালে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় পানিপ্রবাহ নেমে এসেছে ১০৭৬ ঘনমিটারে। ৫০ বছরে প্রবাহ কমেছে ২৬০৯ ঘন মিটার, গড়ে ৭১ শতাংশ। বর্তমানে প্রবাহ আছে ২৯ শতাংশ। খরায় বরেন্দ্র অঞ্চলে ৪৫ শতাংশ জমি অনাবাদি হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) তথ্য মতে, প্রতি বছর ৩০-৪০ লাখ হেক্টর জমির ফসল খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, বছরের পর বছর ধান চাষ করেছি। গত কয়েক বছর পানির অভাবে বীজতলা টিকছে না। সেচ দিতে গিয়ে খরচ বেড়েছে, লাভ নেই। অনেকে জমি ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
গোদাগাড়ীর মৎস্যজীবী হাবিব উল্যাহ জানান, এক সময় জীবিকা ছিল পদ্মানির্ভর। কয়েক দশক নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরে সংসার চালিয়েছেন। মাছ ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় তাঁকে পেশা ছাড়তে হয়েছে।
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী জানান, ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৮ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তার নির্ধারিত পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে ১৯৭১ সালের পর থেকে পানি উত্তোলন এতটা বেড়েছে যে, ২০২১ সালের মধ্যে স্তর গড়ে ১৮ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে। গাছের শিকড় মাটি থেকে পানি টানতে পারছে না। গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। খরা শুধু কৃষিকে নয়, বাস্তুতন্ত্রকে বিপন্ন করে তুলছে।
এত ক্ষতির পরও বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো খরার জন্য নেই জরুরি ব্যবস্থা বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, খরা একটি নীরব দুর্যোগ। ধীরে ধীরে আগাতে থাকে, তেমনই নিঃশব্দে ধ্বংস ডেকে আনে। আজ যদি আমরা পরিকল্পনা না করি, প্রস্তুতি না নিই, তবে আগামী দিনের ভয়াবহতা ঠেকানো কঠিন হবে। এখনই প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ, সম্মিলিত উদ্যোগ এবং খরাকে উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে আনা।
তথ্য তুলে ধরে এ গবেষক বলেন, দেশের গড় তাপমাত্রা গত ৫০ বছরে প্রায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। গড় তাপমাত্রা পরিবর্তন হওয়ায় বৃষ্টিপাতের ধরন ও সময় বদলেছে। এখন আর প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে যথাসময়ে ঋতুর আবির্ভাব ঘটছে না। ঋতুর সংখ্যা কমেছে। এ ছাড়া বিলম্বিত হচ্ছে শীত ও বর্ষার আগমন অথবা অসময়ে ভারী বর্ষণ কিংবা ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। ৩০ লাখ শিশু প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে খরার শিকার। খরাপ্রবণ জেলাগুলোয় মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ জমি মাঝারি থেকে চরম খরার ঝুঁকিতে আছে।
খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম মাসুদ বলেন, খরায় ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিকে ফসল উৎপাদনে সহায়ক করে তোলার জন্য রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে খরাপ্রবণ অঞ্চলে জলবায়ু সহনশীল কৃষি পরিকল্পনা ও ক্ষয়িষ্ণু পানিসম্পদের পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা, ফসলের বৈচিত্র্য এবং আবহাওয়াভিত্তিক কৃষি তথ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, খরায় কৃষি উৎপাদন কমছে। এসব সমস্যার সমাধানে গবেষণা ও প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। কৃষি খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এ জন্য কৃষি, পানি সম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করছে। কৃষি উৎপাদন টেকসই রাখতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হবে।
- বিষয় :
- প্রকৃতি
- বরেন্দ্র অঞ্চল
- খরা