ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

প্রোটিন কমিয়ে গম আমদানি!

প্রোটিন কমিয়ে গম আমদানি!

ফাইল ছবি

ফসিহ উদ্দীন মাহতাব

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২২ | ১৪:১৮

নিম্নমানের গম আমদানি করতে 'স্পেসিফিকেশন' (বিনির্দেশ) পরিবর্তন করেছে সরকার। এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সংগ্রহ শাখার গত ২০ মার্চের স্মারকপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মতামতের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে আমদানি করা গমে প্রোটিনের মাত্রা ১২.৫ থেকে কমিয়ে ১১.৫ শতাংশ করা হয়েছে। তবে বিনির্দেশের অন্য সব মানদণ্ড অপরিবর্তিত থাকবে।

এতদিন খাদ্য মন্ত্রণালয় ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রোটিনসমৃদ্ধ গম আমদানি করেছে। অভিযোগ উঠেছে, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে গম সরবরাহকারী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জোরালো তদবিরের কারণে নতুন এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ (বিএএনসি) এবং বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রোটিনের মাত্রা পুনর্নিধারণের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর পক্ষে অভিমত দিয়েছে।

তবে বাংলাদেশ পুষ্টি সমিতির সভাপতি ড. এস কে রায় সমকালকে বলেন, 'বিদ্যমান প্রোটিনের মাত্রা কমিয়ে ১১.৫ শতাংশ প্রোটিনসমৃদ্ধ গম আমদানি করা গ্রহণযোগ্য নয়। সবার মতামত নিয়ে প্রোটিনের মান নির্ধারণ করলে ভালো হতো। দেশে উৎপাদিত গমে হয়তো প্রোটিন যথাযথ নাও থাকতে পারে; কিন্তু বিদেশ থেকে আনা কম প্রোটিনযুক্ত গম দেশের মানুষ কেন খাবে?'

ড. এস কে রায় বলেন, 'যদি কোনো ব্যবসায়ীর বা ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিদেশ থেকে কম প্রোটিনযুক্ত গম আমদানি করা হয়, তাহলে সেটি কতটুকু যৌক্তিক, তা সংশ্নিষ্টদের ভেবে দেখতে হবে।'
কিন্তু গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. গোলাম ফারুক বলছেন, 'যৌক্তিকতা বিবেচনা করেই ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রোটিনসমৃদ্ধ গমের সুপারিশ করা হয়েছে। এই প্রোটিন মানবদেহের জন্য পর্যাপ্ত। ক্ষতিকর কিছু নয়। তা ছাড়া দেশের অধিকাংশ মানুষই ৭ শতাংশ প্রোটিনসমৃদ্ধ চাল খেয়ে থাকে। সুতরাং সরকার নির্ধারিত প্রোটিনের মাত্রা যথাযথ।' এর আগে গত বছরের এপ্রিলে মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) এক ভার্চুয়াল সভায় বিদ্যমান প্রোটিনের শতাংশ কমিয়ে গম আমদানি করতে 'স্পেসিফিকেশন' পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ওই সময় আমদানি করা গমে প্রোটিনের মাত্রা ১২.৫ থেকে কমিয়ে ১০.৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে এ সভায় কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমসহ কমিটির অন্য সদস্য ও সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা সংযুক্ত ছিলেন।
ওই প্রস্তাবে সায় না দিয়ে তখন একাধিক সদস্য বলেছিলেন, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দিকে যাচ্ছে। সেখানে কেন কম প্রোটিনযুক্ত গম আমদানি করতে হবে? সীমিত সাধ্যের মধ্যেই সর্বোৎকৃষ্ট খাদ্যশস্য আমদানি করা সম্ভব। এ বক্তব্যে কমিটির অধিকাংশ সদস্যই ঐকমত্য হন। যে কারণে প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যায়।
কিন্তু এরপরও তদবির অব্যাহত রাখে গম সরবরাহকারী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। সূত্র জানায়, সম্প্রতি আবারও অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ও এফপিএমসির সভায় আমদানি করা গমের বিনির্দেশে প্রোটিনের পরিমাণ কমানোর প্রস্তাব করা হয়। এমন প্রেক্ষাপটে আমদানি করা গমের বিনির্দেশে প্রোটিনের মাত্রা পুননির্ধারণের ব্যাপারে বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ (বিএএনসি) এবং বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে মতামত চাওয়া হয়।

এরপর বিএনএনসি প্রোটিনের পরিমাণ ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ সুপারিশ করে। গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ করার পরামর্শ দেয়। তবে খাদ্যমন্ত্রী ও সচিব প্রোটিনের পরিমাণ কমাতে রাজি নন বলে তাদের মত জানিয়ে দেন। বলা হয়, গমের মজুত পর্যাপ্ত রয়েছে। তা ছাড়া ইউক্রেন, রাশিয়া, আর্জেন্টিনা এবং পাঞ্জাবেও সাড়ে ১২ শতাংশ প্রোটিনযুক্ত গম পাওয়া যায়।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে সাড়ে ১০ শতাংশ প্রোটিনের গম কেনা হতো। সেই সুযোগে গম সরবরাহকারী একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ব্রাজিল থেকে নিম্নমানের গম আমদানি করে। আমদানি করা এসব গম রেশন হিসেবে সেনাবাহিনী, পুলিশসহ সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে পুলিশ আপত্তি তোলার পর পরিস্থিতি সামাল দিতে গমের বিনির্দেশ বাড়িয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ করা হয়।

এ বিষয়ে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত গমও ১১.৫ শতাংশ প্রোটিনসমৃদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে বৈশ্বিক সমস্যা চলছে। অনেক দেশ নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গম আমদানি করতে চাইছে না। ইতোমধ্যে ভারত থেকে ১২.৫ শতাংশ প্রোটিনসমৃদ্ধ গম আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য স্পেসিফিকেশন কিছুটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এতে খারাপ মানের গম আসবে না বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

আরও পড়ুন

×