সরকারি গাড়িতে আগের মতোই পুড়ছে তেল

দেলওয়ার হোসেন
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২২ | ১৪:২৭
নানামুখী সংকটে তামাম বিশ্ব। এই বৃত্ত থেকে বের হতে চলছে যারপরনাই চেষ্টা। বৈশ্বিক এই সংকট ঠেকাতে সরকারের তরফ থেকেও নেওয়া হয়েছে একগুচ্ছ উদ্যোগ; দেওয়া হয়েছে কিছু নির্দেশনা। এর মধ্যে জ্বালানি সাশ্রয়ের দিকে সরকারের নজর একটু বেশি। এ প্রেক্ষাপটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেওয়া হয়েছে ২০ শতাংশ জ্বালানি কমানোর নির্দেশনা। তবে এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে চলছে ঢিলেমি। জ্বালানির পরিমাণ নির্ধারণে প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি এখনও। ফলে সরকারের সাশ্রয়ের প্রয়াস ধাক্কা খেতে পারে।
সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাধিকার পাওয়া কর্মকর্তাদের জ্বালানি সুবিধা এখনও কমেনি। সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি নেওয়ার পরও প্রকল্প এবং অধিদপ্তরের গাড়ি ব্যবহার করছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা। এসব গাড়ির বেশিরভাগ জ্বালানি খরচ হচ্ছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাজেট থেকে। মন্ত্রী, সচিব ও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জন্য জ্বালানি খরচ নির্ধারণ করা থাকলেও তা এখনও সংশোধন করা হয়নি। ফলে জ্বালানি খরচ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কর্মকর্তারা। তবে জ্বালানি সাশ্রয়ে শুধু যানবাহন অধিদপ্তরের কর্মচারীদের যাতায়াতের গাড়ি কমানোসহ কিছু সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে।
জানা যায়, প্রাধিকার পাওয়া তিন হাজার উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব ও সিনিয়র সচিরের গাড়ির পেছনে মেরামত, চালক ও জ্বালানি বাবদ বছরে ১৮০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এর পরও এ খাতে জ্বালানির লাগাম টানা হয়নি। যানবাহন অধিদপ্তর থেকে পাওয়া গাড়ি চিহ্নিত করেনি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। এ সুযোগে প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও শেষ হওয়া চলমান প্রকল্পের গাড়ি অবৈধভাবে ব্যবহার করছে। প্রায় প্রত্যেক মন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) ও সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) সরকারি গাড়ি হাঁকাচ্ছেন। অবৈধভাবে ব্যবহার করা এসব গাড়ির জ্বালানি খরচ হচ্ছে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাজেট থেকে। এ জন্য জ্বালানি খাতে কোটি কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দও রাখা হয়েছে।
এই অর্থবছরে ৪৭ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর জন্য গাড়ির জ্বালানির পেছনে বরাদ্দ রয়েছে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্বালানি সাশ্রয়ী হতে মন্ত্রীদের গাড়ি নিয়ে বেশি ছোটাছুটি না করার নির্দেশনা দিয়েছেন। সে নির্দেশনা কতটুকু মন্ত্রীরা মানছেন, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
চার মন্ত্রণালয়-বিভাগে জ্বালানি বরাদ্দ ৭ কোটি টাকা: যানবাহন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সরকারি গাড়ি আছে ১ হাজার ৭৫০টি। এর মধ্যে ৮ বিভাগীয় কমিশনার, ৬৪ জেলা প্রশাসক ও ৪৯২ ইউএনও কার্যালয়ে আছে ১ হাজার ৫০০টি গাড়ি। বাকি ২৫০টি গাড়ি চলছে ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে। এতে প্রতি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ভাগে পাচ্ছে অন্তত ৫টি গাড়ি। যানবাহন অধিদপ্তরের গাড়ি সরবরাহ কম হলেও মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে জ্বালানি খাতে বরাদ্দ রয়েছে কোটি কোটি টাকা। এ খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ রয়েছে- মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ে ৬৫ লাখ টাকা ও স্থানীয় সরকার বিভাগে ৫৫ লাখ টাকা। এতে ৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বরাদ্দ রয়েছে ৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ফলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০ শতাংশ জ্বালানি খরচ কমানো হলেও যানবাহন অধিদপ্তরের গাড়ির চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি খরচের পর টাকা থেকে যাবে। আর এই বাকি টাকা অবৈধ গাড়িতে ব্যবহার হতে পারে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী সমকালকে বলেন, 'জ্বালানি খাতের বরাদ্দের টাকায় কতটি গাড়ি চলছে এবং যানবাহন অধিদপ্তরের কয়টি গাড়ি এলজিআরডি বিভাগে আছে, সে তথ্য এ মুহূর্তে আমার জানা নেই। নথি দেখে বলতে হবে।'
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব সায়েদুল ইসলাম বলেন, যানবাহন অধিদপ্তর থেকে কয়টি গাড়ি মন্ত্রণালয়ে রয়েছে, এ তথ্য প্রশাসন অনুবিভাগের কর্মকর্তারা বলতে পারবেন। মন্ত্রণালয়ে ব্যবহূত প্রকল্প ও অধিদপ্তরের গাড়িগুলোর জ্বালানি কীভাবে খরচ হচ্ছে- এ প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বেশিরভাগ অনুবিভাগপ্রধান (অতিরিক্ত সচিব) অবৈধ গাড়ি ও জ্বালানি সুবিধা নিচ্ছেন। শেষ হওয়া প্রকল্পের গাড়িগুলো বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও উদ্ধার করতে পারছে না সরকার। আবার প্রাধিকার পাওয়া অনেক কর্মকর্তা সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি কেনার পরও মন্ত্রণালয়ের মাইক্রোবাসগুলো ব্যবহার করছেন। এতে যেসব কর্মকর্তার এসব মাইক্রোবাসের সুবিধা পাওয়ার কথা, তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
সিনিয়র সচিব, সচিব, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) প্রতি মাসে ২৫০ লিটার পেট্রোল বা অকটেন অথবা ৩৫৮ ঘনমিটার সিএনজি পাচ্ছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) ২১০ থেকে ২৫০ লিটার পেট্রোল বা অকটেন অথবা ৩০০ থেকে ৩৫৮ ঘনমিটার সিএনজি ব্যবহার করছেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্মকর্তারা পাচ্ছেন ১৮০ লিটার পেট্রোল বা অকটেন। নির্ধারিত এ জ্বালানি সুবিধা কমিয়ে প্রজ্ঞাপন সংশোধন করা হয়নি। বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, 'জ্বালানি ব্যবহার কমানোর ব্যাপারে কোনো প্রজ্ঞাপন পাইনি। তবে জ্বালানি খাতে বরাদ্দের টাকা ২০ শতাংশ কমাতে বলা হয়েছে; সেটা জেনেছি।'
চালকদের বিরুদ্ধে তেল চুরির অভিযোগ: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১০ জনেরও বেশি জেলা প্রশাসক বলেন, ছোট-বড় সব জেলার ডিসির জন্য ২৫০ লিটার পেট্রোল বা অকটেন বরাদ্দ রয়েছে। আবার সিএনজিচালিত গাড়ি চালুর জন্য মাসে ৩০ লিটার তেল বরাদ্দ থাকে। এতে চারটি উপজেলার একটি জেলার ডিসির গাড়িচালক ২৫০ লিটার তেল ব্যবহার করে। আবার ১৫টি উপজেলার একটি জেলার ডিসির গাড়িচালকও ২৫০ লিটার তেল ব্যবহার করে। সব জেলায় সমান বরাদ্দ থাকায় ডিসিরা কিছু বলতে পারেন না। তাই জ্বালানির শুধু বরাদ্দই কমানো নয়; পরিমাণ নির্ধারণ করা জরুরি। এই অর্থবছর ৬৪ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জ্বালানি খাতে বরাদ্দ রয়েছে সাড়ে ৩৬ কোটি টাকা। ৪৯২ ইউএনওর কার্যালয়ে বরাদ্দ রয়েছে ১৬ কোটি টাকা।
শুধু যানবাহন অধিদপ্তরের কর্মচারীদের সুবিধা কমেছে: জ্বালানি সাশ্রয়ের নির্দেশনার পর শুধু যানবাহন অধিদপ্তর তা কার্যকর করেছে। ওই অধিদপ্তরের কর্মচারীদের যাতায়াতের ১২টি মাইক্রোবাসের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ৬টি। মেরামত করা গাড়ি পরীক্ষার জন্য বরাদ্দের দুই লিটার তেল থেকে এক লিটার করা হয়েছে। সিএনজিচালিত গাড়ি চালুর জন্য ৩০ লিটার তেল থেকে ১৫ লিটার, আবার ১৫ লিটার থেকে ৮ লিটার করা হয়েছে।
এ ছাড়া ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের যেসব গাড়ি কর্মচারীদের নিয়ে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ জেলায় যাতায়াত করে, সেসব গাড়ির সর্বশেষ যাত্রী অবতরণস্থলে গাড়িসহ চালক রাত্রিযাপন করছে। পরদিন নির্ধারিত সময়ে যাত্রীসহ ওই গাড়িগুলো সচিবালয়ে আসছে।
সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিচালক আহমেদ ফয়সল ইমাম বলেন, 'জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য আমাদের অধিদপ্তরের কর্মচারীদের অর্ধেক গাড়ি বন্ধ করা হয়েছে। সিএনজিচালিত গাড়ি চালু ও পরীক্ষার জন্য ব্যবহূত তেলও কমানো হয়েছে। তবে অন্য কোনো মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের কর্মচারীদের গাড়ি কমানো কিংবা জ্বালানি সাশ্রয়ের কোনো তথ্য আমার কাছে নেই।' প্রাধিকার পাওয়া কর্মকর্তাদের তেলের পরিমাণ কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।' কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক একেএম ফজলুজ্জোহা বলেন, 'জ্বালানি সাশ্রয়ের কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আরও কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এ সংক্রান্ত গঠিত কমিটি কাজ করছে।'
প্রকল্পের গাড়ি উদ্ধারে তোড়জোড়: শেষ হওয়া প্রকল্পের গাড়ি উদ্ধারে বহুবার চিঠি দেওয়ার পরও উদ্ধার করতে পারছে না সরকার। প্রকল্প সমাপ্তির পর হাজার হাজার গাড়ি থাকলেও চলমান সংকটে অনেক চেষ্টার পর এই জুলাইয়ে মাত্র ২টি গাড়ি জমা হয়েছে। গত অর্থবছরে জমা পড়ে প্রায় ৪০টি গাড়ি। সর্বশেষ গত বুধবার পরিবহন কমিশনার আবদুস সাত্তার আইএমইডির সচিবকে এ ব্যাপারে ফের চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে প্রকল্প শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে গাড়ি সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরে জমা দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া এসব গাড়ি উদ্ধারের জন্য কাল সোমবার বৈঠক ডেকেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।