ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ভারতীয় ঋণ

যুগ পার আশ্বাস আর আশায়

যুগ পার আশ্বাস আর আশায়

আবু হেনা মুহিব

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৪:৩২

কঠিন শর্ত ও অর্থ ছাড়ের দীর্ঘসূত্রতায় ভারতীয় ঋণ সহায়তার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই। ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় ৪৬ প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ১২ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। কোনোটির বাস্তবায়ন কাজ রয়েছে মাঝপথে; আবার কোনো কোনোটির কাজ শুরু করা যায়নি এখনও। সময়মতো ঋণ না পাওয়ায় কোনো কোনো প্রকল্পে ভারতীয় ঋণের আশা বাদ দেওয়া হয়েছে। বিকল্প অর্থায়নের মাধ্যমে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

প্রতিশ্রুত ৭ দশমিক ৮৬২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১ বিলিয়ন ডলারের মতো ছাড় করেছে ভারত। বাংলাদেশ-ভারত সরকারে মধ্যে এলওসির আওতায় প্রকল্পগুলো পর্যালোচনার জন্য উচ্চ পর্যায়ের একটি তদারক কমিটি কাজ করছে। এ কমিটিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শর্ত শিথিল এবং অর্থ ছাড় দ্রুত করার অনুরোধ করা হয়েছে। কমিটির ভারতীয় প্রতিনিধিরাও এ দুই বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছেন। তবে দৃশ্যমান কোনো ফল চোখে পড়ছে না।

এলওসির ঋণের অপেক্ষায় থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রকল্প সরকার নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্যাকেজ-৬ এর রিভারক্রসিং (২০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ) বিভিন্ন জটিলতার পর প্রকল্পটি এলওসি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এলওসি-৩ এর আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের নির্ধারিত তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র নিতে হয়েছে। এতে দেখা যায়, দরপত্রে প্রস্তাবিত দর প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অনেক বেশি। প্রতিযোগিতামূলক দর পাওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতীয় তিন ঠিকাদারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের সম্মতি চাওয়া হয়। ইআরডির মাধ্যমে ভারতীয় হাইকমিশনে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়। তবে এক্সিম ব্যাংক শুধু ওই তিন ঠিকাদারের মধ্যেই পুনঃদরপত্র আহ্বানের পরামর্শ দেয়। মানসম্পন্ন কাজ এবং অন্যায্য খরচ এড়াতে আন্তর্জাতিক দরপত্রের প্রয়োজনীয়তা তুলে আবারও ইআরডির মাধ্যমে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। গত ৬ মে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত এলওসি পর্যালোচনা বৈঠকে এলওসি তালিকা থেকে প্রকল্পটি বাদ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এ বিষয়ে এখনও কিছু জানায়নি ভারত। প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় আর সময় নষ্ট না করে সরকারের নিজস্ব অর্থেই বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধনে পরিকল্পনা কমিশনের অনুমতি এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানোর জন্য ইআরডির কাছে চিঠি দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ভারত আসলে ব্ল্যাকমেইল করছে। দেশটির আমলারা তাদের জাতীয় স্বার্থের বাইরে কিছু দেখে না। আমাদেরও ন্যায্যতার ভিত্তিতে জাতীয় স্বার্থ দেখা উচিত। প্রকল্পের কেনাকাটায় যে কোনো দর নয়; ন্যয্য দর নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, এলওসির প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন বিষয়ে অযথাই সময় নষ্ট করা হলো। নিজস্ব অর্থায়ন কিংবা বিকল্প অর্থায়নে করার সিদ্ধান্ত আরও আগে নেওয়া প্রয়োজন ছিল। তাহলে সময় নষ্ট হতো না। দেরিতে বাস্তবায়নের খেসারত হিসেবে এখন বেশি খরচও গুনতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন দিল্লি সফরেও ভারতীয় এলওসি নিয়ে আলোচনার আশা কম। বিদেশি উৎস থেকে ঋণ ও অনুদান সহায়তা সংগ্রহে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল বিভাগ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) এ নিয়ে কোনো কার্যক্রম নেই। এলওসির শর্তের জটিলতা নিরসন এবং সময়মতো অর্থ ছাড় বিষয়ে কোনো তৎপরতা নেই। জানতে চাইলে ইআরডি সচিব শরিফা খান সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফর উপলক্ষে এলওসি সংক্রান্ত কোনো আলোচনা থাকবে কিনা, আমার জানা নেই। ইআরডির পক্ষ থেকে এ নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। প্রধানমন্ত্রীর সফরে ইআরডির কোনো প্রতিনিধিও থাকছেন না।

২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় বাংলাদেশকে ৭ দশমিক ৮৬২ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত। ৩ ধাপে এই ঋণ দেওয়ার কথা। এলওসি-১ এর আওতায় ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১০ সালে দুই দেশের মধ্যে ঋণ চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা। ওই ঋণের ১৪ কোটি ডলার অনুদান দেয় ভারত। বাকি ৮৬ কোটি ডলারের মধ্যে ৫৭ কোটি ডলার ছাড় করেছে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক। ওই টাকা দিয়ে ১০ বছরে ১২টি প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় এলওসি-২ এর আওতায় ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার জন্য সমঝোতা চুক্তি সই হয়। এ পর্যন্ত ছাড় করা টাকার পরিমাণ মাত্র ৫ কোটি ডলারের মতো। এলওসির এ ধাপের আওতায় ১৬টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৮০ লাখ ডলার ব্যয়ে বিআরটিসির জন্য ট্রাক কেনা এবং ৪ কোটি ৬৬ লাখ ডলার খরচে ডাবল ও সিঙ্গেল ডেকার এসি ও নন-এসি বাস সংগ্রহ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি প্রকল্পের কোনোটিরই কাজ শেষ হয়নি। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় ৪৫০ কোটি ডলারের এলওসি-৩ এর ঘোষণা আসে। ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তি সই হয়। এলওসির এ ধাপের আওতায় ১৬টি প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়। বাকি ১৫টির মধ্যে তিনটি কেনাকাটা পর্যায়ে এবং ১২টি পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়েছে। তৃতীয় এলওসির অর্থ এ পর্যন্ত মাত্র ১০ লাখ ডলারের কিছু বেশি। শেষ অর্থবছরে মোট ৩২ কোটি ৪২ লাখ ডলার অর্থ ছাড় করে ভারত। এ নিয়ে মোট ৯৪ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ছাড় করা হয়েছে।

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, মূলত এলওসির জটিল শর্তের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন থমকে আছে। শর্তের মধ্যে বলা আছে, বিভিন্ন প্রকল্পের প্রয়োজনীয় ৭৫ শতাংশ সরঞ্জাম ও সেবা ভারত থেকে নিতে হবে। অনেক সময় এসব পণ্য ভারতে পাওয়া যায় না; পাওয়া গেলেও মানসম্পন্ন হয় না। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতিযোগিতামূলক দরে এসব পণ্য কিনতে চায় বাংলাদেশ। এলওসির আওতায় থাকা প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন পর্যালোচনায় দু'দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রকল্প তদারক কমিটি রয়েছে। ওই কমিটির শেষ বৈঠকে ভারত থেকে ৫০ শতাংশ সরঞ্জাম কেনার পর বাকিটা বাংলাদেশ কিংবা অন্য দেশ থেকে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। অন্য শর্তের মধ্যে রয়েছে- প্রকল্পের ঠিকাদার হতে হবে ভারতীয়। এ ছাড়া প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ, দরপত্র প্রণয়ন, প্রকল্পের নকশা তৈরি ও দরপত্র চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া ভারতে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে নিতে হবে। ঋণের সুদের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১ শতাংশ; প্রতিশ্রুতি ফি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। খেলাপি হলে ২ শতাংশ হারে দণ্ড সুদ ধার্য রয়েছে। ৫ বছরের রেয়াত কালসহ ২০ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।


আরও পড়ুন

×