ভারতের ঋণ
রেল প্রকল্পে শামুকগতি

রাজীব আহাম্মদ
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৪:৩১
এক যুগেও শেষ হয়নি ভারতের ঋণে খুলনা-মোংলা ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্প অনুমোদনের সময় নির্মাণকাজ তিন বছরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। ১২ বছরেও কাজ তো শেষ হয়ইনি, উল্টো ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে অনুমোদনের সময়, ৫ বছরে খুলনা-দর্শনা এবং পার্বতীপুর-কাউনিয়া রেলপথ নির্মাণ পরিকল্পনা ছিল। তবে ওই কাজ ৪ বছর ৮ মাসেও শুরু করা যায়নি। বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণকাজের দেখভালে ৪ বছরের চুক্তিতে ২৫ আগস্ট পরামর্শক নিয়োগ চুক্তি হয়েছে। প্রকল্প দুটির মেয়াদ নিশ্চিতভাবেই ৪ বছর বাড়তে যাচ্ছে। এ দুই প্রকল্পে পৌনে ৫ বছরে এক টাকাও ঋণ দেয়নি ভারত।
শুধু এই তিনটি নয়, ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) এবং অনুদানে চলমান রেলের সাত প্রকল্পেরই ত্রিশঙ্কু দশা। বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ঋণ ছাড়ে গড়িমসি, নানা শর্ত, প্রতিটি ধাপ অনুমোদনে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকে জটিলতায় কাজ সামনে এগোচ্ছে না। ঋণের শর্তানুযায়ী ভারতীয় ঠিকাদার ও পরামর্শক নিয়োগ এবং নির্মাণসামগ্রী কেনার বাধ্যবাধকতায়ও কাজের গতিতে ছেদ পড়ছে। এসব বিষয়ে ভারতকে অনুরোধ আর তাগাদা দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না।
আগামী মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাচ্ছেন। সফরে রেলের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে সমঝোতা স্মরক সই হবে। তবে ঋণের টাকা দ্রুত ছাড়ের বিষয়ে আলোচনা হবে কিনা- তা জানাতে পারেননি রেল কর্মকর্তারা।
প্রথম ও দ্বিতীয় এলওসিতে ১৬ হাজার ৮১৬ কোটি টাকায় ছয়টি প্রকল্প চলছে রেলে। ভারত ঋণ দেবে ১১ হাজার ৬১০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বাকি টাকা বাংলাদেশের। রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এ বছরেই দুই দফা এলওসি প্রকল্পের ধীরগতিতে ক্ষোভ জানান। গত জুনে ভারত সফরে গিয়েও তাগিদ দেন। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে ঋণের টাকা ছাড়ে জটিলতা নিরসনে অনুরোধ করেন। তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। তবে রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীর গত সপ্তাহে সমকালকে বলেছেন, প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করতে দুই দেশ যৌথভাবে তদারকি করছে। যেসব জটিলতা রয়েছে, সেগুলো কাটাতে কাজ চলছে।
খুলনা-মোংলা রেলপথ: প্রথম এলওসির প্রকল্প খুলনা-মোংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজের অগ্রগতি জুলাই পর্যন্ত হয়েছে ৯৫ শতাংশ। সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা না করে ২০১০ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। সে সময়ে ৬৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণে খরচ ধরা হয় ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। দুই দফায় বেড়ে তা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
ঋণের শর্তানুযায়ী ভারতীয় ঠিকাদার কাজ করছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পর্যালোচনা অনুযায়ী, ভারতীয় ঠিকাদারের লারসেন অ্যান্ড টু ব্রো লিমিটেডের সরবরাহ করা স্লিপার ছিল নিম্নমানের। তা বাতিল হওয়া, অনভিজ্ঞ সাব-কন্ট্রাক্টর নিয়োগ এবং জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় কাজে দেরি হচ্ছে।
গত আগস্টে পরিদর্শনে গিয়ে রেলমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এ বছরেই চালু হবে খুলনা-মোংলা রেলপথ। তবে প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান জানান, এক বছর ডিফেক্ট লাইবেলিটি পিরিয়ডসহ ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রকল্প মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
সিগন্যালিং ব্যবস্থার ঠিকাদার নিয়োগেও জটিলতা হয়েছে। দুটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৫৭ শতাংশ বেশি ব্যয় প্রস্তাব করে। জটিলতা কাটাতে নিজস্ব অর্থায়নে সিগন্যালিংয়ের কাজ করছে বাংলাদেশ। ঠিকাদার নিয়োগ হলেও এখনও কাজ শুরু হয়নি। প্রকল্প পরিচালক সমকালকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদার ৫ মাস সময় পাবে সিগন্যালিংয়ের কাজে। অক্টোবরে কাজ শুরু হয়ে মার্চে শেষ হবে।
কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ: ২০১১ সালের জুলাইয়ে অনুমোদিত কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্পে খরচ বেড়েছে ৪৭৭ শতাংশ। জুলাই পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। এই অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় (এডিপি) প্রকল্পটিতে ৮৭ কোটি ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ ৬৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা পাওয়া যাবে বলে ধরা হয়েছে। তবে ছাড় হওয়া ৬৮ কোটি ৯২ লাখ টাকার মধ্যে ভারতীয় ঋণের পরিমাণ মাত্র ১৬ কোটি ১০ লাখ টাকা।
৫২ কিলোমিটার কুলাউড়া-শাহবাজপুর পুনর্বাসন কাজ করছে ভারতীয় ঠিকাদার 'কালিন্দ রেল নির্মাণ'। প্রকল্প অনুমোদনের ৬ বছর পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে চুক্তি হয়। এতে প্রকল্প খরচ ১৪২ কোটি থেকে বেড়ে ৬৭৮ কোটি টাকা হয়েছে। বারবার তাগিদ দিয়েও ঠিকাদারকে দিয়ে কাজ করাতে পারেনি রেল। কখনও করোনা, কখনও জমি ও বিদ্যুতের খুঁটি বা গাছের অজুহাত দিয়েছে। ভারতীয় ঠিকাদারকে বাদ দিতে চুক্তি বাতিল করতে চায় রেলওয়ে। তবে এলওসির ঋণে ভারতীয় ঠিকাদার দিয়ে কাজ করানোর বাধ্যবাধকতা থাকায় তা করা যাচ্ছে না। আইএমইডি বলছে, নতুন করে প্রাক্কলন ও ঠিকাদার নিয়োগে দুই বছর সময় লাগবে।
ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইন: এই প্রকল্পে ১০ বছরে কাজ হয়েছে ৬৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আগামী বছরের জুনে কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থার কারণে ২০২৪ সালের জুনের আগে ঢাকা প্রকল্পটি কিছু অংশের কাজ করাই সম্ভব নয়। ১ হাজার ১০৬ কোটি টাকার ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ রেললাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন প্রকল্পে ভারত ঋণ দেবে ৯০২ কোটি টাকা। এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে ২৩৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ ২১৯ কোটি টাকা। তবে ছাড় হওয়া মাত্র ৫ কোটি ১২ লাখ টাকার মধ্যে ভারতীয় ঋণের এক পয়সাও নেই।
বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ: এলওসির ঋণে ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রকল্প অনুমোদনের পর ৪ বছরে পৌনে ৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। এ বছরের এডিপি প্রকল্পটির জন্য ২১৮ কোটি বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে ভারতের ঋণ মাত্র ১৮ কোটি টাকা।
৯৮ কোটি টাকায় সমীক্ষা করতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান রাইটস ইন্ডিয়া লিমিটেড এবং আরভি ইন্ডিয়াকে পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। এখনও ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র হয়নি। যদিও ৫ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। নিশ্চিতভাবেই সময় ও খরচ বাড়তে যাচ্ছে।
২০১০ সালের প্রাক-সমীক্ষায় যে পথ ধরে (অ্যালাইনমেন্ট) বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেললাইন নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছিল, সেখানে বহুতল ভবন, বাজার, সড়ক তৈরি হওয়ায় অ্যালাইনমেন্ট বদলের সুপারিশ করেছে পরামর্শক। তবে তাতে আপত্তি রয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের (এমপি)। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের এমপি হাবিবে মিল্লাত বলেন, রায়গঞ্জ স্টেশনকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে সরাতে চায় রেলওয়ে। এমপিরা একমত নন। আরিয়াবাজারে 'ওয়াই লাইন' করার পরিকল্পনাতেও আপত্তি রয়েছে।
খুলনা-দর্শনা ও পার্বতীপুর-কাউনিয়া রেলপথ: ২০১৮ সালে অনুমোদিত ৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকায় খুলনা-দর্শনা ১২৬ কিলোমিটার ডাবল লাইন এবং ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকায় পার্বতীপুর-কাউনিয়া পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার ডাবল লাইন নির্মাণকাজ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। তবে গত ২৫ আগস্ট পরামর্শক নিয়োগ হয়েছে। এই দুই প্রকল্পে এ বছরে এক টাকাও ভারতীয় ঋণ ছাড় হয়নি। পৌনে ৫ বছরে এক টাকাও দেয়নি ভারত।
আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ: ৪৭৮ কোটি টাকায় ১০ দশমিক ১ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণে ৪২১ কোটি টাকা অনুদান দেবে ভারত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ চালুর পরিকল্পনা ছিল। তবে জুলাই পর্যন্ত অগ্রগতি সাড়ে ৬০ শতাংশ। জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, করোনার অজুহাত দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় ঠিকাদার বাড়তি টাকা চাইছে। ত্রিপুরার সংবাদমাধ্যমের খবর, ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের উত্তর-পূর্বাঞ্চল মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কাজ এগোয়নি।
- বিষয় :
- ভারতের ঋণ
- এলওসি
- ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক