পরিবর্তনের পথদ্রষ্টা: কামাল কাদীরের জীবনের প্রেরণার কথা

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ০২:৩৮ | আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ০০:৪১
মুঠোফোনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আর্থিক লেনদেন হবে, এমনটা চিন্তা করা ক’বছর আগেও অসম্ভব ছিল। তবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করে কোটি মানুষকে আর্থিক সেবা পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন প্রেরণার কথা’র তৃতীয় সিজনের দ্বিতীয় পর্বের অতিথি মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদীর। বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থার অন্যতম উদ্যোক্তা ও পথিকৃত তিনি। দেশের মোবাইল আর্থিক সেবার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান কামাল কাদীর পরিচালিত এই বিকাশ।
কামাল কাদীরের উদ্যোগেই ২০১০ সালে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড-এর সাথে মাত্র ৩৭ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করে বিকাশ। সেই ৩৭ জন থেকে বেড়ে আজ ১৭শ’র বেশি কর্মী এবং প্রায় ৩ লাখের বেশি এজেন্ট কাজ করছে বিকাশে। সম্প্রতি দেশের প্রথম ইউনিকর্ন স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বিকাশ। গত ১১ বছরে বিকাশের এই উত্থান বিস্ময়কর। আর এই উত্থানের গল্পটাও চমকপ্রদ। সেই গল্পই এই সাক্ষাৎকারে কামাল কাদীর তুলে ধরেছেন। বিকাশ প্রতিষ্ঠার পেছনের অজানা গল্পের পাশাপাশি, কথা বলেছেন তরুণদের নিয়ে তার ভাবনা, জানিয়েছেন তার ছেলেবেলা ও পড়ালেখা নিয়ে।
১৯৭১ সালে, বাংলাদেশর স্বাধীনতা অর্জনের বছরেই জন্মগ্রহণ করেন কামাল কাদীর। যশোরে, ১০ ভাই-বোনের এক বড় পরিবারে কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে বেড়ে উঠেছেন। ১৯৭২ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর বেশ কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে সকল ভাই-বোনকে বড় করেছেন তার মা। শৈশবকাল সম্পর্কে কামাল কাদীর বলেন, “আমাদের মধ্যে সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান দেওয়ার আগেই বাসায় ফেরার একটা নিয়ম ছিল। আমি ছোটবেলা থেকেই ভোর ছ’টার পরে কোনদিন ঘুমিয়েছি, আমার মনে পরে না। যশোরে পড়াশোনা করেছি স্থানীয় একটা ক্যাথলিক স্কুলে। কিন্তু বাসায় একজন শিক্ষক আসতেন, তারাপদ দাস। তারাপদ দাস স্যারের একটি গভীর প্রভাব ছিল আমার ওপর। যশোর শহরে একটা পাবলিক লাইব্রেরি আছে, ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত। ওই পাবলিক লাইব্রেরিটা আমার জীবনে একটা ভূমিকা রেখেছে।”
যুক্তরাষ্ট্রে ইকোনমিকস্ এবং আর্টস্-এ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে মাটির টানে কামাল কাদীর দেশে ফিরে আসেন। ফেরেন জন্মভূমির জন্য নতুন কিছু করার প্রত্যয় নিয়ে। বিদেশের উন্নত জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে ফিরে আসা সম্পর্কে কামাল কাদীর বলেন, “বাংলাদেশ তো কখনো আমার ভেতর থেকে বের হয়নি, হৃদয়ে বাংলাদেশ সবসময়ই ছিল। আর বিদেশে একদম ছোটবেলায় যাইনি, ১৮ বছর বয়সে গিয়েছি। সুতরাং বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ধারণা নিয়ে গিয়েছি। বাংলাদেশের প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল। একটা তাগিদ বোধ করেছি চিরকাল এবং কিছু কিছু লোকের সাথে পরিচয় হয়েছে যারা জাতি গঠনে এমন ভূমিকা রেখেছে যে প্রতিনিয়তই আমার মনে হয়েছে তাদের মতন কাজ করতে পারলে খুব ভালো হত।”
নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা থেকেই কামাল কাদীরের মনে বিকাশ প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত। তার ব্রেইনচাইল্ড বিকাশ আজ দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। বিকাশ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সম্পর্কে কামাল কাদীর বলেন, “আমি বিদেশে পড়াশোনা করতে যেয়ে এমন জায়গায় পড়াশোনা করেছি যেখানে টেকনোলজি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, টেকনোলজিতে এক্সপোজার পাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। দেশের জনগণের কাছে কিছু মৌলিক প্রযুক্তি হাতের মুঠোয় আছে যেমন মোবাইল-ফোন তার মধ্যে একটি। এটাকে দিয়ে সর্বোচ্চ কি করা যেতে পারে সেই তাগিদ থেকেই বিকাশ নিয়ে চিন্তাভাবনা।”
তবে, বিকাশ প্রতিষ্ঠারও আগে সেলবাজার দিয়ে প্রথম উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কামাল কাদীর। সেসময়, বাংলাদেশের প্রথম সারির ই-কমার্স প্লাটফর্ম এবং সর্বাধিক ব্যবহার্য অনলাইন মার্কেটপ্লেস হিসেবে সুনাম ছিল সেলবাজারের। “সেলবাজার নামে একটি ইকমার্স কোম্পানির সাথে আমি যুক্ত ছিলাম, শুরু হয়েছিল ২০০৫ সালে। ছাত্র অবস্থায় শুরু করেছিলাম। আমি সেলবাজার থেকে দেখেছি সবার কাছে মোবাইল ফোন আছে। দামি মোবাইল হোক আর সস্তা মোবাইল হোক, যদি গ্রাহকের প্রয়োজন বুঝে এমন ভাবে একটা ডিজাইন করা যায় যে এই প্রযুক্তির মাধ্যমেই সার্ভিস পাওয়া যাবে, তাহলে ফোন দিয়েও একটা আর্থিক সেবা দেওয়া সম্ভব। সেটা থেকেই পরবর্তীতে বিকাশ নিয়ে চিন্তা। কেনিয়াতে এ ধরনের একটা সার্ভিস আগেই চালু হয়েছে। আমি ২০০৮-২০০৯ সালে কেনিয়াতে গিয়েছি কয়েকবার। তারপরে বাংলাদেশে স্যার ফজলে হাসান আবেদের সাথে এটা নিয়ে কথা হলো। তিনিও বললেন ব্র্যাককে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে।”
বিকাশের প্রতিষ্ঠাকাল হতে বর্তমানের যাত্রা প্রসঙ্গে কামাল কাদীর তার সহকর্মীদের পরিশ্রমকে কৃতিত্ব দেন। এর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি বলব যে এটা করতে পারার সদিচ্ছার সাথে ন্যাশন বিল্ডিং-এর প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল আমার কিছু কলিগের। তারাও এটার পেছনে দিন নেই রাত নেই খেটেছে … আমার কাছে মনে হয় ২০১০ সালের দিকে যদি আমরা না করতাম, কেউ-না-কেউ করতো। যে দেশের মানুষের কাছে মোবাইল ফোন আছে, যে দেশের মানুষের বেসিক এডুকেশনাল স্কিল আছে, ন্যাশনাল ডেটাবেজ আছে, সেখানে এরকম একটা জিনিস গড়ে তোলা অবশ্যই উচিত ছিল। আমি খুব আনন্দের সাথে বলছি এবং আল্লাহর প্রতি একরকম শুকরিয়া নিয়ে বলছি এরকম একটা উদ্যোগে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে।”
তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ ও আইডিয়া সম্পর্কে কামাল কাদীর বলেন, “আইডিয়া ১ পারসেন্ট প্রকাশ করে, ৯৯ পারসেন্ট হচ্ছে সেটাকে বাস্তবায়ন করা। কেউ যদি একটা আইডিয়া নিয়ে হঠাৎ করে একটা বাধার সম্মুখীন হয়, এতে ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই। একটা আইডিয়া কাজ করছে না, আরেকটা আইডিয়া করবে। আপনি একটি আইডিয়া নিয়ে খুব কাজ করছেন, হয়ত দেখবেন ওই আইডিয়া নিয়ে আরেকজন কাজ করছে। এটাতো স্বাভাবিকই। আমি একাই শুধু সব চিন্তা করতে পারব অন্য কেউ পারবে না এটাতো সম্ভব না। সুতরাং তরুণরা যেন কোনোভাবেই তাদের উৎসাহ না হারায়।”
অনেকেই বলে থাকেন ভালো উদ্যোক্তা হতে হলে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদেশী ডিগ্রী প্রয়োজন। কামাল কাদীর এ বিষয়ে বলেন, “আমেরিকায় যে ৫০০ ফরচুন কোম্পানি আছে, এর মধ্যে হয়তো ১০০ কোম্পানির সিইওর কলেজ ডিগ্রী নেই। বাংলাদেশের কিছু কিছু উদ্যোক্তা আছেন তাদের কাজ এত ভাল, এত বড় ভূমিকা রেখেছেন, ওনারা আমার জানামতে বিদেশে পড়াশোনা করেননি। পড়াশোনার মৌলিকটা তো পরিবারে এবং আপনার চিন্তা করতে পারার শক্তিটা তৈরী হয় বাসায়। তবে হ্যাঁ, আমি অবশ্যই ভালো স্কুলে পড়ার যে উপকার সেটাকে একেবারেই অবমূল্যায়ন করতে চাচ্ছি না। কিন্তু আমি বলব বিদেশে পড়লেই যে সব কিছু হবে, না পড়লে হবে না এরকমটা না। সুতরাং যে উদ্যোক্তা বন্ধুরা বিদেশে পড়াশোনা করেননি, তাদের আমি বলব ওটা নিয়ে একেবারেই চিন্তা না করতে।”
ভবিষ্যতে তরুণ প্রজন্মের কি ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন হবে এবং তাদেরকে কিভাবে তৈরি হওয়া উচিত; এই বিষয়েও কামাল কাদীর কথা বলেন। বলেন মৌলিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। তিনি বলেন, “আমার কাছে মনে হয় বিবিএ খুব ভালো সাবজেক্ট, কিন্তু সবাই যেন বিবিএ না পড়ে। দরকার বেসিক সাইন্স, বেসিক হিউম্যানিটি। দেশ অর্থনীতিতে উন্নতি করছে, আমাদের ভালো ভালো প্রেজেন্টেশন করা দরকার, এটাকে তুলে ধরা দরকার। কিন্তু একটা পর্যায়ে আমাদের যখন মৌলিক কিছু জিনিস নিয়ে কাজ করতে হবে, তখন আমাদের মৌলিক বিজ্ঞানের নলেজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। আজ থেকে ২০ বছর আগে যখন একটা ইনভেস্টর আসতো বাংলাদেশে, তারা হয়তো জিজ্ঞাসা করতো আমাকে কোথায় জমি দিবা, আমার গ্যাসের কানেকশন কিভাবে পাব, আমার বিদ্যুতের কানেকশন কিভাবে পাব। এখন যারা আসবে তারা জিজ্ঞেস করবে তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কম্পিউটার সাইন্সে কোন কোন কোর্স করানো হয়। আমার মনে হয় ওই মৌলিক জায়গাগুলোতে আমাদের আগামীদিনের যে প্রজন্ম আসবে তাদেরকে যেন আমরা স্কিলড করতে পারি।”
নিজ জীবনদর্শন এবং কর্মক্ষেত্রে তার প্রতিফলন প্রসঙ্গে কামাল কাদীর বলেন, “হার্ডওয়ার্ক এর কোন অল্টারনেটিভ নেই। আপনি যতই প্রতিভাবান হোন না কেন, হার্ডওয়ার্ক-এটার কোন অল্টারনেটিভ নেই।”
প্রেরণা ফাউন্ডেশন কর্তৃক সম্প্রচারিত প্রেরণার কথা’র অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র অধ্যাপক ড. মেলিতা মেহজাবিন এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন। প্রেরণার কথা’র তৃতীয় সিজনের দ্বিতীয় পর্বের সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি দেখা যাবে প্রেরণা ফাউন্ডেশনের ইউটিউব চ্যানেলেঃ https://youtu.be/1HM5k-V4dD8
- বিষয় :
- প্রেরণার কথা
- বিকাশ
- কামাল কাদীর