বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন
ঘূর্ণিঝড়ে বছরে ক্ষতি ১০ হাজার কোটি টাকা

ফাইল ছবি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২২ | ১০:২৭ | আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২২ | ১০:৪২
গুরুতর জলবায়ু ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। শুধু ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এ দেশে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলার বা ১০ হাজার কোটি টাকা। ঘূর্ণিঝড় বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। তবে বড় ধরনের বন্যা হলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৯ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ জিডিপিতে কৃষির অবদান কমতে পারে বর্তমানের এক-তৃতীয়াংশ। এতে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে দেশের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে অভিবাসী হতে পারেন।
বিশ্বব্যাংকের জলবায়ুর অভিঘাত সংক্রান্ত 'কান্ট্রি ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট' প্রতিবেদনে বর্তমান ক্ষতি এবং আগামীতে ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করা হয়েছে। সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
প্রতিবেদনে জলবায়ুর অভিঘাত প্রশমনে জ্বালানি দক্ষতা বাড়ানো, বিদ্যুতের সঞ্চালনা উন্নত করা, বায়ুদূষণ ও যানজট কমানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে নীতি ও বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে দ্রুত সংস্কারের কথাও বলা হয় এতে। দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য জলবায়ু সহিষ্ণুতা জোরদার করতে অবকাঠামো এবং সেবায় বিনিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। উন্নত কৃষি উৎপাদনশীলতা এবং জ্বালানি ও পরিবহন দক্ষতা কার্যক্রম নেওয়া হলে বায়ু, মাটি এবং পানির গুণগত মান বাড়ানোর পাশাপাশি ভবিষ্যতে কার্বন নিঃসরণ কমতে পারে। এসব বিষয়ে খুব দ্রুত জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া না হলে দরিদ্র এবং দুর্বল ও ঝুঁকিতে থাকা মানুষের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। যা দেশের উন্নয়নের গতিকে দুর্বল করবে বলে প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়।
অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, জলবায়ু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ক্ষয়ক্ষতি তার বড় প্রমাণ। সরকার জলবায়ুর ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন। প্রতিবেদনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জলবায়ুর ক্ষতির অনুমানের জন্য বিশ্বব্যাংককে ধন্যবাদ জানান তিনি। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকসহ অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সরকার কাজ করতে চায় বলেও জানান মন্ত্রী।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইসার বলেন, অভিযোজন এবং দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ। গত ৫০ বছরে দেশটি ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ ভাগ কমিয়েছে, অন্যান্য দেশ যা থেকে শিখতে পারে। কিন্তু জলবায়ু ঝুঁকি বাড়তে থাকায় অভিযোজন প্রচেষ্টা জোরদার করা জরুরি।
আইএফসির এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক ভাইস প্রেসিডেন্ট জন এফ গ্যানডলফো বলেন, জলবায়ু ঝুঁকি প্রশমনে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন। অর্থের জোগানের পাশাপাশি উদ্ভাবন ও দক্ষতা ব্যবস্থাপনাও এগিয়ে নিতে বেরসরকারি খাতের সক্ষমতা রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের মাল্টিলেটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি স্কিমের (মিগা) নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিরোশি মাতানো বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল অব্যাহত রাখতে হবে।
৩২ শতাংশ মৃত্যু পরিবেশ দূষণে :বাংলাদেশের মানুষের মোট মৃত্যুর ৩২ শতাংশ হয় বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ দূষণের কারণে। বিশেষত বায়ুদূষণ, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, হাইজিনে ঘাটতি ও সিসাদূষণ। শুধু বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের বছরে ক্ষতির পরিমাণ মোট জিডিপির ৯ শতাংশ। বন্যায় একই পরিমাণে ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়া ২০৪০ সাল নাগাদ কৃষিজমি কমতে পারে সাড়ে ৬ শতাংশ। দক্ষিণাঞ্চলে এ হার ১৮ শতাংশ হতে পারে। তবে বায়ুদূষণ এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব।
বিদ্যুৎ বিভ্রাটে বছরে ক্ষতি ৬০০ কোটি টাকা :দেশে জ্বালানি সংকট চলছে। এর প্রধান কারণ, জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। উৎপাদন বাড়লেও সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতায় ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে প্রতি বছর জিডিপির দেড় শতাংশ ক্ষতি হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্য মতে, বাংলাদেশের জিডিপির আকার এখন ৩৯ হাজার ৭৬৫ লাখ কোটি টাকা। সে হিসাবে বিদ্যুৎ বিভ্রাটে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৫৯৬ কোটি টাকারও বেশি। প্রতিবেদনে জ্বালানি ভর্তুকি এবং অদক্ষ শিল্পে স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়। সব খাতে জ্বালানি দক্ষতা ও সংরক্ষণ মহাপরিকল্পনাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে এতে স্থানীয় এবং বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
অভিঘাত প্রশমনে ১২৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন :বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ৩টি অগ্রাধিকার চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- মানবকেন্দ্রিক জলবায়ুবান্ধব স্থানীয় উন্নয়ন, কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং পরিবেশ ও প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্বিন্যাস জোরদার করা। এসব অগ্রাধিকার বাস্তবায়নে মধ্যমেয়াদে জলবায়ুকেন্দ্রিক বিনিয়োগে প্রয়োজন হবে ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। এই অর্থ জোগানে সরকারি এবং বেসরকারি খাতের অর্থায়ন প্রয়োজন। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং পরিবেশ প্রয়োজন। এ জন্য সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনাও জোরদার করতে হবে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে জলবায়ু সচেতনতা বাড়াতে কর্মসূচি, গবেষণা, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র কারখানায় জ্বালানি সাশ্রয়ী কার্যক্রম জোরদার করার কথা বলা হয়েছে।