শিক্ষাঙ্গনে টর্চার সেল-২
জাবিতে নবীনদের ওপর নির্যাতন চলে কথায় কথায়

আবু নাঈম তরুণ, জাবি
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০১৯ | ১৩:১৬
ম্যানার শেখানোর নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের
শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে হরহামেশাই। ভিন্নমত প্রকাশ করলে বা
অন্য ব্যানারে আন্দোলন করলেও পড়তে হয় ছাত্রলীগের রোষানলে। এসব ঘটনায়
বিভিন্ন সময় সাধারণ শিক্ষার্থীর কান ফাটানো, হাত-পা ভাঙা, এমনকি মানসিক
সমস্যার সম্মুখীন করে ফেলার ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। অশ্নীল গালাগালি এবং
অঙ্গভঙ্গির মতো ঘটনা ঘটে প্রতিনিয়ত। ভুক্তভোগী সাধারণ শিক্ষার্থীদের
বর্ণনায় র্যাগিংয়ের এমন চিত্রই পাওয়া যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এসব ঘটনায় সবসময় থাকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের
নাম।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশেষ করে রাতে হলের গণরুমে তাদের একসঙ্গে ম্যানার
শেখানোর নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। সিনিয়রদের চোখে যখন তাদের
কারও দোষ হয়, তখন রাতে তাকে বিশেষভাবে শাস্তি দেওয়া হয়। চড়থাপ্পড়, অতিরিক্ত
পানি পান করানো, জানালার গ্রিলে এক হাত আর এক পা দিয়ে ঝুলে থাকা, কান
ধরানোর মাধ্যমে সিনিয়ররা তাদের শাস্তি দেন। যা চলে গভীর রাত পর্যন্ত।
সিনিয়ররা তাদের নিজেদের রুমে ডেকে নিয়েও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন।
এসব ঘটনায় প্রায়ই নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন, কিন্তু তারা ভয়ে
কোনো অভিযোগ করেন না।
জাহাঙ্গীরনগরে ছেলেদের হলের তুলনায় মেয়েদের হলে কম নির্যাতন হয়। ছেলেদের
প্রতিটি হলের গণরুমই যেন একেকটা টর্চার সেল। দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের এমন
ঘটনা ঘটলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তেমন উদ্যোগী হয়নি বলে অভিযোগ
শিক্ষার্থী ও ক্রিয়াশীল বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের। এসব বিষয়ে
শিক্ষার্থীরা নির্যাতনের বর্ণনা দিলেও অধিকাংশই নাম প্রকাশে রাজি হননি।
গণরুমে নির্যাতনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রথম
বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, 'আমি দুই দিন নির্যাতনের শিকার হয়েছি। দুই দিনই
আমাকে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়েছিল তারা। একদিন কারণ হিসেবে ছিল আমি নাকি এক
সিনিয়রকে সালাম দেইনি। অন্যদিনের কারণ ছিল আমি হলের দোকানে গিয়ে নাস্তা
করেছিলাম।'
নির্যাতনের শিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি
ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী এবং আল বেরুনী হলের আবাসিক ছাত্র শিবলুল হক শোভন
বলেন, 'প্রথম বর্ষে থাকতে চুল লম্বা ছিল আমার। প্রতিদিন আমাকে চুলের জন্য
গালাগালি করা হতো। এমনকি আমার জন্য আমার বন্ধুদেরও নির্যাতন করত তারা। পরে
একদিন মনের দুঃখে মাথা ন্যাড়া করে ফেলি।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি-অস্বচ্ছতার অভিযোগ এবং
পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথমবর্ষের
শিক্ষার্থী সোহায়েব ইবনে মাসুদকে মারধর করেন ছাত্রলীগের আল বেরুনী হলের
কর্মী সাইফুর রহমান। এ বিষয়ে সোহায়েব বলেন, 'ওই দিন দুর্নীতির বিরুদ্ধে
জাহাঙ্গীরনগর ব্যানারে অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমিও মশাল মিছিলে অংশ নিই।
রাতে হলের দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে
মিটিংয়ে বসে। সেখানে ছাত্রলীগের এক কর্মী মশাল মিছিলে যাওয়ার কারণ জানতে
চায়। আমি বলি দাবিগুলো যৌক্তিক তাই আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। একপর্যায়ে সে আমার
দিকে একটি পানিভর্তি বোতল ছুড়ে মারে। বোতলটি এসে আমার বুকে লাগে। এরপর সে
আমাকে বুকে আঘাত করে এবং কলার টেনে ধরে শার্টের বোতাম ছিঁড়ে ফেলে।' অবশ্য
সাইফুর রহমান সরকারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, 'এটি একটি
কল্পিত অভিযোগ। মারধরের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।'
ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম অনিক বলেন,
'জাহাঙ্গীরনগরে ছেলেদের প্রত্যেকটা হলের গণরুমই ছাত্রলীগের অঘোষিত
রিক্রুটসেল। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তারা গণরুমগুলোকে কনসেনট্রেশন
ক্যাম্পে পরিণত করে রেখেছে। প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে অবগত
থাকার পরেও কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেন না। এর পেছেনে কেন্দ্রীয়
রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিক মনোভাবই বহুলাংশে দায়ী।'
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ দিদার বলেন, 'প্রথম
বর্ষের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন রাতে, কখনও ভোর পর্যন্ত শারীরিক-মানসিক
নির্যাতন করা হয়, মূলত করে থাকে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ। প্রশাসন সবকিছু জানার
পরও কোনো ব্যবস্থা নেয় না। কেউ কেউ ছাত্রলীগের কাছে তারা অসহায় বলে মন্তব্য
করেন।'
চলতি বছরের জুলাই মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সিনিয়র
শিক্ষার্থীর থাপ্পড়ে কান ফাটে গণিত বিভাগের প্রথম বর্ষের (৪৮তম ব্যাচ)
শিক্ষার্থী মো. ফয়সাল আলমের। সিনিয়র এক শিক্ষার্থী ক্ষিপ্ত হয়ে ফয়সালের
কানে দুটি থাপ্পড় দেন। ফলে ফয়সালের কান থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে। মওলানা
ভাসানী হলে মোশাররফ হোসেন নামের রসায়ন বিভাগের এক শিক্ষার্থীকেও নির্যাতন
করে কান ফাটিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৮ সালে শহীদ রফিক-জব্বার হলে
র্যাগিংয়ের নামে সিনিয়ররা শারীরিকভাবে নির্যাতন করায় পরিবেশবিজ্ঞান
বিভাগের আজাদ রহমান অসুস্থ হন। একই বছর র্যাগিংয়ের নামে নির্যাতনের কারণে
কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের মিজানুর রহমান মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে
পড়েছিলেন। ২০১৭ সালে রসায়ন বিভাগের শরিফুল ইসলাম গণরুমে নির্যাতিত হয়ে
অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এসব ঘটনার প্রত্যেকটিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নাম
জড়িত।
শিক্ষার্থীদের এ ধরনের নির্যাতন 'ছাত্রলীগের দাস' তৈরির একটি প্রক্রিয়া
দাবি করে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান বলেন,
'শিক্ষার্থীদের এ ধরনের নির্যাতনের ফলে তারা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে।
প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় বর্ষে উঠলে তারা আবার প্রতিশোধ নিতে চায়।
এভাবে তাদের সন্ত্রাসীতে রূপান্তরিত করা হয়।'
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি জুয়েল রানা বলেন, 'আমাদের
কোনো কর্মীই র্যাগিংয়ের সঙ্গে জড়িত নয়। ঢালাওভাবে এ ধরনের অভিযোগ করা
হচ্ছে। এটা আগে ছিল কিন্তু আমরা এই সংস্কৃতি বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা এ বিষয়ে
কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি। কেউ যদি অতিউৎসাহী হয়ে এমন করে তবে আমরা তার
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।'
প্রাধ্যক্ষ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক বশির আহমেদ বলেন, 'অন্যান্য বছরের তুলনায়
র্যাগিং অনেকটা কমে আসছে। সামনে আরও কমবে বলে আমরা আশাবাদী। র্যাগিং
বন্ধের জন্য আমরা হলের বিভিন্ন জায়গায় সিসি ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগ
নিয়েছি। আর কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক আমির হোসেন র্যাগিংয়ের
বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের 'জিরো টলারেন্স' নীতি রয়েছে বলে জানান। তিনি
বলেন, 'আমাদের এ নীতি অব্যাহত থাকবে। এখনও ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। তবে
নবীনরা আসার আগেই আরও উদ্যোগ নেওয়া হবে।'
- বিষয় :
- শিক্ষাঙ্গনে টর্চার সেল-২