রোগীদের বিপদে ফেলে অর্থ আদায়ের চেষ্টা স্যানডোরের

তবিবুর রহমান ও শৈবাল আচার্য
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৩ | ১৮:০০
কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিসে সরকারি সেবার পাশাপাশি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) চুক্তির ভিত্তিতে সেবা দেয় ভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস। বেসরকারিভাবে ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণত দরিদ্র রোগীরাই সরকারি হাসপাতালে স্যানডোরের সেবা নেন। সরকারি হাসপাতালগুলোয় ডায়ালাইসিসের সুবিধা কম থাকায় তারাও এই সেবার জন্য অনেকটাই স্যানডোরের ওপর নির্ভরশীল। এর সুযোগ নিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানটির স্বেচ্ছাচারিতা যেন দিন দিন বাড়ছে। পাওনা টাকা আদায়ের অজুহাতে আগাম নোটিশ ছাড়াই ডায়ালাইসিসের মতো জরুরি সেবা হঠাৎ বন্ধ করে দিতেও বাধছে না তাদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের কাছ থেকে বকেয়া বিল আদায়ে রোগীদের বিপদে ফেলে সেবা বন্ধ করে দেওয়াকে কৌশল হিসেবে নিয়েছে স্যানডোর। গত এক বছরে অন্তত ১০ বার সেবা বন্ধ করেছে তারা। এতে প্রতিনিয়ত রোগীদের ভোগান্তি আর হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী স্যানডোর হুটহাট সেবা বন্ধ করতে পারে না।
জানা গেছে, কার্যকারিতা অনুযায়ী একজন কিডনি রোগীকে মাসে অন্তত ৮ থেকে ১২ বার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। বেসরকারিভাবে একবার ডায়ালাইসিস করাতে রোগীকে গুনতে হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। স্বাভাবিকভাবে দরিদ্রদের পক্ষে এত টাকা বহন অসম্ভব। সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিসে সরকার নির্ধারিত কোনো ফি নেই। এখানে মাত্র ৫০০ টাকায় এক সেশন ডায়ালাইসিস করা যায়। এই অবস্থায় নির্ভরতা থেকেই অধিকাংশ দরিদ্র রোগী ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুটি হাসপাতালে সেবা নিতে আসেন। দেশে হওয়া মোট ডায়ালাইসিসের ১০ শতাংশ হচ্ছে দুই হাসপাতালে।
রোগীদের এই নির্ভরতার সুযোগ নিচ্ছে স্যানডোর। পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গত ছয় মাসে অন্তত চারবার ঢাকা ও চট্টগ্রামে সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২১ জুন ঢাকার জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট (এনআইকেডিইউ) ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল সেন্টারের সামনে ডায়ালাইসিস বন্ধের নোটিশ টাঙিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। সরকারের কাছ থেকে বকেয়া বিল না পাওয়া, কাঁচামাল সংকটসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে গত ২ ফেব্রুয়ারি এবং ১০ ও ১৯ জানুয়ারিও একই কাজ করেছিল তারা। গত বছরও নানা অজুহাতে বেশ কয়েকবার ডালালাইসিস বন্ধ রাখে স্যানডোর। ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি রোগীদের জিম্মি করে বকেয়া আদায়ের চেষ্টা করে প্রতিষ্ঠানটি।
এনআইকেডিইউ পরিচালক অধ্যাপক ডা. বাবরুল আলম বলেন, কারণ ছাড়া এমন গুরুত্বপূর্ণ সেবা হুট করে স্যানডোর বন্ধ রাখতে পারে না। এটা চুক্তিতেও উল্লেখ নেই। সরকারের কাছে স্যানডোর ২২ কোটি টাকা পায়। বকেয়া টাকা পর্যায়ক্রমে তাদের পরিশোধও করা হচ্ছে। তার পরও তারা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গড়িমসি করে।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘কিছুদিন পর পর নানা অজুহাতে সেবা বন্ধ করে দেওয়া স্যানডোরের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রোগীদের বেকায়দায় ফেলে তাদের এমন আচরণে আমরা বিব্রত। প্রতিষ্ঠানটির এসব বিষয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। তারা এভাবে সেবা বন্ধ করতে পারে না।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রামের সম্পাদক আকতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘গরিব-অসহায় রোগীদের এ চিকিৎসা খরচ রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে। সুলভমূল্যে কিডনি রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে না পারা দুর্ভাগ্যের।’
এ বিষয়ে স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস ঢাকার দায়িত্বরত কর্মকর্তা শামসুন নাহার সমকালকে বলেন, ‘ঈদের আগে বকেয়া বিলের কিছু অংশ পরিশোধের আশ্বাসে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সেবা চালু রাখা হয়েছে। করোনার সধ্যে ডায়ালাইসিস সেবার পরিধি বাড়ায় বড় অঙ্কের টাকা বকেয়া পড়ে যায়। এখন ২২ কোটি টাকা বকেয়া আছ। এর আগে কাঁচামাল সংকটের কারণে সেবা বন্ধের নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।’
প্রতিষ্ঠানটির চট্টগ্রামে দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা বলেন, বকেয়া পরিশোধে বারবার বিলম্ব ও অসহযোগিতার কারণে অনেক সময় সেবা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সাড়া পেলে এমন পরিস্থিতি হতো না।
ডায়ালাইসিস সেবা প্রসারের পরিকল্পনা সরকারের
চমেকে বর্তমানে ডায়ালাইসিস মেশিনের সংখ্যা মাত্র ১৭টি। যা দিয়ে প্রতিদিন মাত্র ৫১ জনকে ডায়ালাইসিস প্রদান সম্ভব। অথচ রোগীর সংখ্যা এর ১০ গুণের বেশি। ঢাকায়ও এনআইকেডিইউতে বর্তমানে ৫৮টি মেশিনের মাধ্যমে ডায়ালাইসিস চলছে। নতুন করে ৩০টি মেশিন বসানোর জায়গা তৈরি করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘হাসপাতালের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ডায়ালাইসিস সেবার প্রসারে সরকার প্রতিটি জেলায় ১০ শয্যার ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপনে কাজ করছে।’
- বিষয় :
- স্যানডোর
- কিডনি রোগী
- ডায়ালাইসিস