ডোপ টেস্টে ভোগান্তি চালকদের

প্রতীকী ছবি
জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৩ | ১৮:১৩ | আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৩ | ১৭:২৯
সড়কে বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, সিএনজি, টেম্পো, পিকআপ ভ্যান, মোটরসাইকেল, করিমন, নছিমন ইত্যাদি যানবাহনের চাপায় পিষ্ট হয়ে প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিলের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। দুর্ঘটনার প্রধান কারণ এবং বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের জন্য প্রধানত মাদকাসক্তিকে দায়ী করা হয়। এমন পরিস্থতিতে মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো বন্ধ করতে গত বছরের ৩০ জানুয়ারি থেকে পেশাদার মোটরযান-চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে বা নবায়ন করতে ডোপ টেস্ট সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই সনদ ছাড়া চালকরা নতুন লাইসেন্স ও পুরনো লাইসেন্স নবায়ন করতে পারবেন না। কিন্তু ডোপ টেস্ট সনদ নিতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন অনেকে। এতে অনেক চালক লাইসেন্স নবায়ন ও ইস্যুতে আগ্রহী হচ্ছেন না। চালকরা নির্ধারিত হাসপাতালে গিয়ে ডোপ টেস্ট করতে পড়ছেন বিপাকে।
রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে মহিব উল্যাহ নামে এক চালক কয়েক দিন ঘুরেও সিরিয়াল দিতে পারেননি। চার দিন ঘুরাপর তিনি সিরিয়াল পেয়েছেন। আগামী দুই মাস পর পরীক্ষা তাকে করিয়ে যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু তার লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ। লাইসেন্স নবায়ন না করলে গাড়ি চালাতে পারবেন না তিনি।
এ দিকে ডোপ টেস্টে চলছে শুভঙ্করের ফাঁকি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কেউ এক হাজার ন্যানোগ্রামের বেশি এমফিটামিন বা ইয়াবা সেবনের তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে ডোপ টেস্ট করালেই কেবল তার রিপোর্ট পজিটিভ আসবে। নির্দিষ্ট এই সময়ের মধ্যে এক হাজার ন্যানোগ্রামের কম ইয়াবা সেবন করলে ডোপ টেস্টেও ধরা পড়বে না। আবার সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে এই সময়ের মধ্যে ডোপ টেস্ট না করালে বা তিনি ওই সময়ে মাদক গ্রহণ না করলে মাদকসেবী প্রমাণের সুযোগ খুবই কম।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নত দেশের মানদণ্ড মেনে আধুনিক পদ্ধতিতে চুল, লোম, নখ থেকে নমুনা সংগ্রহ করলে সেবনকারীর শরীরে এক মাসের বেশি সময় ইয়াবা এবং তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত গাঁজার অস্তিত্ব পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া বর্তমান পদ্ধতিতে যথাযথ ফল পেতে হলে সন্দেহভাজনদের বুঝে ওঠার আগেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডোপ টেস্টের আওতায় আনা উচিত।
রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালগুলোতে লোকবলের অভাবে প্রতিদিন অল্প কিছু মানুষের পরীক্ষা হচ্ছে। এ ছাড়া হাসপাতালের কর্মীরা এটিকে বাড়তি দায়িত্ব হিসেবেই দেখছেন। যে পরিমাণ মানুষ আসছে, তাতে প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে সিরিয়ালের নম্বর।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের তথ্য বলছে, দেশে মোট ৭০ লাখ পরিবহন শ্রমিক আছেন। এর মধ্যে গাড়িচালক প্রায় ২৫ লাখ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদক বন্ধ করতে চালকদের ডোপ টেস্ট প্রক্রিয়ার গতি বাড়েনি বরং ভোগান্তি বেড়েছে।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বড় একটি অংশ মাদকাসক্ত। এতে বোঝা যাচ্ছে, বিআরটিএ চালকদের ডোপ টেস্টের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তা কাজে আসছে না। যে প্রক্রিয়ায় এটি হচ্ছে, তা অবৈজ্ঞানিক। এভাবে না করে সন্দেহভাজনদের পরীক্ষা করা হলে ভালো ফল দিত। সেটি টার্মিনাল বা রাস্তার পাশে বা যেকোনো জায়গায় হতে পারে। বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি থাকলেও সেখানে নতুন এ প্রক্রিয়া সংযোজন করা হয়েছে। হঠাৎ সিদ্ধান্তের কারণেই মুখ থুবড়ে পড়েছে ডোপ টেস্ট।
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্যমতে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত চালকদের মধ্যে মাদকাসক্ত ছিলেন ১২ থেকে ১৪ শতাংশ। ২০২০-২১ সালে এটি বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ২২ থেকে ২৪ শতাংশে।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সরকার অনেক ভালো উদ্যোগ নেয়, সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ছোটখাটো কারণ বা নানা অজুহাতে অনেক কিছু বাস্তবায়ন হয় না। আমার কথা হলো, গাড়ির চালকেরা সহজে যেন এ সনদ পেতে পারেন, তার জন্য সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা করতে হবে। এটাই জরুরি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘ডোপ টেস্ট আরও সহজভাবে করতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যেহেতু পরীক্ষা আমরা করি না, তাই অনিয়মের বিষয়টিতেও বিআরটিএর কোনো করণীয় নেই। তারপরও এ বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবো।’