ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস আজ

নানা চাপে পিষ্ট আইন

নানা চাপে পিষ্ট আইন

রাজীব আহাম্মদ

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০১৯ | ১৪:১১ | আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৯ | ১৪:৩০

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় অনুমোদন পেয়েছিল বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮। তা কার্যকর হয়নি গত এক বছরেও। কার্যকরের আগেই পরিবহন নেতাদের চাপে আইনটি শিথিল করার আয়োজন শুরু হয়েছে। ফলে সড়কে নিরাপত্তা আদৌ আসবে কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইন প্রণয়নের দাবিতে আন্দোলনকারীরা। আইন নিয়ে দোলাচলের মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।

এদিকে, এ মাসেই শেষ হতে চলেছে সড়ক পরিবহন আইনের বিধিমালা তৈরি করার কাজ। এ বিধিমালা প্রণয়ন-সংক্রান্ত উপকমিটির প্রধান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত মাসে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বৈঠকের পর ইঙ্গিত দেন, আইন শিথিল হতে যাচ্ছে। যদিও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তা নাকচ করেছেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, অংশীজনের কাছ থেকে যেসব মতামত এসেছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে তারা একটি প্রতিবেদন তৈরি করবেন। তা জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে দেওয়া হবে। কাউন্সিল এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

এদিকে, মালিক সংগঠন সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ বলেন, 'আইনের অনেক কিছুই মালিক-শ্রমিকদের স্বার্থের পরিপন্থি। এ কারণেই আইনটি সংশোধনের দাবি তোলা হয়েছে। একটি বাস দুর্ঘটনা ঘটালে তার দায় মালিককে কেন নিতে হবে? মালিক তো বাস চালায় না।'

আইন সংশোধন না হলে মালিক-শ্রমিকরা আন্দোলনের দিকে যাবে কি-না- জানতে চাইলে সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, 'মালিক-শ্রমিকরা তাদের আপত্তি ও দাবির কথা সুস্পষ্টভাবে সরকারের কাছে তুলে ধরেছেন। তারপরও যদি আইনে সংশোধন না আসে তা হলে আর কিছু বলার নেই। মালিকরা পরিবহন ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন।' আইন সংশোধনের প্রস্তাব এবং দাবি তুললেও চাপ সৃষ্টির অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরে আদালতের নির্দেশনা চেয়ে রিটকারী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, আইন এখনও কার্যকর হয়নি, সংশোধনের দাবি কেন আসছে? আগে আইন সড়কে কার্যকর হোক,  তারপর না বলা যাবে সংশোধন করার প্রয়োজন আছে, না নেই। তার আগেই আইন শিথিল করার দাবি তোলা অন্যায় চাপ সৃষ্টি ছাড়া কিছুই নয়।

১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ দিয়ে চলছে দেশের পরিবহন খাত। যুগোপযোগী আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১০ সালে। এরপর সাত বছরে চারবার আইনের খসড়া করা হয়। প্রতিবারই তা আটকে যায় পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপে। ২০১৭ সালের মার্চে আইনের খসড়া মন্ত্রিসভার নীতিগত অনুমোদন পায়। তারপর আবার ঝুলে যায়।

গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বেপরোয়া বাসের চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হন। এর পর সারাদেশে রাস্তায় নেমে আসে শিক্ষার্থীরা। তাদের ৯ দফার দাবির অন্যতম ছিল, এ ধরনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে কঠোর আইন প্রণয়ন। আন্দোলনের মুখে ওই বছরের ৫ আগস্ট মন্ত্রিসভার অনুমোদন পায় আট বছর ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইন। সেপ্টেম্বরে সংসদে পাসের পর ৮ অক্টোবর তা গেজেট আকারে প্রকাশ পায়।

এ আইনের ২ ধারায় বলা হয়েছে, 'সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যে তারিখ নির্ধারণ করবে, সেই তারিখে এই আইন কার্যকর হবে।' মনজিল মোরসেদ বলেছেন, এ ধারার কারণে এ আইনটি কার্যকর হচ্ছে না। তবে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বলছে, বিধিমালা না হওয়ায় আইন প্রয়োগ করা যাচ্ছে না।

আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি ছিল, সড়কে বেপরোয়া গাড়ির কারণে প্রাণহানির বিচারে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখতে হবে। সরকারের মন্ত্রীরাও বলেছিলেন, মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকা উচিত। তবে আইনে দুই বছর বাড়িয়ে পাঁচ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আন্দোলনকারীরা এ সাজাকে কম বললেও, মালিক-শ্রমিকরা একে বেশি বলছেন।

গত ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় আইন কার্যকরের উপায় খুঁজতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে উপ-কমিটি হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন এ কমিটির সদস্য। উপ-কমিটির কাছে মালিক শ্রমিকরা ৬৪টি আপত্তি তুলেছে বলে জানিয়েছে সূত্র।

সড়ক পরিবহন আইনে চালকের জন্য অষ্টম ও সহকারীর জন্য পঞ্চম শ্রেণি পাসের শর্ত দেওয়া হয়েছে। ৯৮ ধারায় বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণহীন বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে কাউকে আহত করলে চালককে তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ১০৫ ধারায় বলা হয়েছে, সড়কে মৃত্যু ঘটালে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড হবে। এ ধারাগুলোর বিরোধী পরিবহন শ্রমিকরা। সড়ক পরিবহন আইনে চালকের লাইসেন্সে ১২ পয়েন্ট রাখা হয়েছে। আইন ভাঙলে পয়েন্ট কাটা যাবে। সব পয়েন্ট কাটা গেলে বাতিল হবে লাইসেন্স। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, চালক-শ্রমিকরা গরিব। তাদের পকেটে কি পাঁচ লাখ টাকা থাকে?

আইন প্রণয়নের উদ্যোগের আট বছর পর পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের এসব বক্তব্যকে অনৈতিক চাপ হিসেবেই দেখছেন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি বলেন, আইন পাসের পর শিথিল করা হলে, তা হবে পরিবহন নেতাদের চাপের কাছে সরকারের আত্মসমর্পণ। প্রতিটি ধাপ পার হয়ে আইনটি সংসদে পাস হয়েছে। প্রতি ধাপে অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়েছে। এ আইন একটি আন্দোলনের ফসল। তা শিথিল হলে সড়কে নিরাপত্তা আসবে না।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের নেতা, চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর এ আইন হয়েছে। যখনই আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখনই একটি গোষ্ঠী জনগণকে জিম্মি করে বাধা দেয়। গত বছর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে বাধা দিতে পারেনি। এখন এরা আবারও সক্রিয় হয়েছে।

ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানোর অপরাধে গত শনিবার চট্টগ্রামে বাস মালিককে ১৫ দিন এবং চালক ও তার সহকারীকে এক মাস করে সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর 'প্রতিবাদে' গতকাল সোমবার চট্টগ্রামে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেন পরিবহন মালিকরা। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সমকালকে বলেছেন, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ওপর আইন প্রয়োগ হলে গাড়ি বন্ধ করে দিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করা হয়। এ জিম্মি করার সংস্কৃতি বন্ধে আইন কার্যকর জরুরি।

সড়ক পরিবহন আইনে মালিকদের সাজা বেড়েছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালালে ছয় মাসের জেল ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানা, অতিরিক্ত পণ্যবহনে এক লাখ টাকা জরিমানা ও এক বছর জেল, গাড়ির আকার পরিবর্তন করলে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ জরিমানা,- এরকম 'কঠোর সাজার' বিরোধী মালিকরা। একাধিক মালিক বলেন, এসব ধারা কার্যকর হলে সড়কে অধিকাংশ যানবাহন বন্ধ হয়ে যাবে। অধিকাংশ গাড়ির আকার-আয়তন ব্লু-বুকের সঙ্গে মিল নেই।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক সমকালকে বলেন, গাড়ির আকার আয়তনের মিল না থাকা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এ কারণে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারায়। সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ বলেন, গাড়ি মালিকরা তৈরি করেন না। কোম্পানি তৈরি করে। তা হলে মালিকরা কেন সাজা পাবেন? যদিও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ মালিকই বাড়তি মুনাফার লোভে গাড়ির আকার আয়তন পরিবর্তন করেন।

দিবসের কর্মসূচি: আজ সকাল ১০টায় রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে সকাল সাড়ে ৭টায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আয়োজনে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হবে। এতে অংশ নেবেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিকেল ৪টায় রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনালসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সড়ক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হবে। দেশের সব জেলা ও উপজেলায়ও দিবসটি উপলক্ষে শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও সড়ক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ভিডিওচিত্র প্রদর্শনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

×