ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

দেশে বাড়ছে শকুন, বাড়ছে প্রজনন

দেশে বাড়ছে শকুন, বাড়ছে প্রজনন

বিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বনে শকুন- ছবি: সাকিব আহমেদ

জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৩:১১ | আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৩:১১

'শকুনের দোয়ায় গরু মরে না'- বহুল প্রচলিত এ প্রবাদেও শকুনকে উপস্থাপন করা হয়েছে নেতিবাচকভাবে। কবিতা, রাজনৈতির মাঠে বক্তৃতা, বিবৃতিতেও—এ পাখির নাম মিলিয়ে গায়েল করা হয় প্রতিপক্ষকে। অমঙ্গল, হিংস্র, শত্রু, লোভী—আরও কত কী! অথচ বাস্তবে মরা-পচা খেয়ে বেঁচে থাকা পরিবেশ-প্রকৃতির পরম বন্ধু এ পাখি। প্রাণীর মরদেহের রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে শকুন। অথচ পরিবেশের এমন নিবেদিত বন্ধু এখন মহাবিপন্ন পাখিতে পরিণত হয়েছে। বিরূপ পরিবেশ, খাদ্য সংকট, গাছ কাটা, মৃত পশুর মাংসে ক্ষতিকর ব্যথানাশক ওষুধের উপস্থিতির কারণে হারিয়ে গেছে শকুন। সারা দেশে শকুনের সংখ্যা কমলেও হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বনে প্রজননহার বেড়েছে। 

বন বিভাগ ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) দেশে ২০১৪ সাল থেকে শকুনের পরিচর্যা নিয়ে কাজ করছে। ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং খুলনার সুন্দরবনে বিলুপ্তপ্রায় শকুনের জন্য দুটি 'নিরাপদ এলাকা' ঘোষণা হয়। সেখানে শকুন সংরক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়, যেখানে শকুন নিরাপদে প্রজনন ও বিশ্রামের সুযোগ পায়। এতে রেমা-কালেঙ্গায় শকুনের প্রজনন সফলতাও বেড়ে যায়। ২০১৪ সালের শুমারি অনুযায়ী দেশে শকুনের সংখ্যা ২৬০, এরমধ্যে ৭৫টি শকুনই হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গায়। সারা দেশে শকুনের প্রজননহার অপরিবর্তিত থাকলেও হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বনে প্রজননহার বেড়েছে। ২০১৪ সালে প্রজনন হার ছিল ৪৪ শতাংশ, ২০২০ সালে সেটি বেড়ে ৫৭ শতাংশ হয়। রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণীতে ২০২১-২২ মৌসুমে ১৪টি শকুনের বাসার মধ্যে ১০টি সাফল্য এসেছে, প্রজনন হার ৭১ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২২-২৩ মৌসুমে ১৮টি বাসার মধ্যে ১৩টিতে সফলতা পাওয়া গেছে, প্রজনন হারা ৭২ দশমিক ২ শতাংশ। যা গত বছরের তুলনা ০.৮২ শতাংশ বেশি। সর্বশেষ ২০২৩ সালে আইইউসিএন এর শুমারিতে ২৬৭টি শকুনের অস্তিত্ব মিলেছে।

এ অবস্থায় শনিবার পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস’। বিপর্যয়ে পড়া শকুন সংরক্ষণ এবং বংশবৃদ্ধির তাগিদ থেকে সারাবিশ্বে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালিত হয়ে আসছে। দিনটি উপলক্ষ্যে বন বিভাগ ও আইউসিএন মৌলভীবাজারের শিল্পকলা একাডেমিতে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। 

শকুন গবেষকরা বলছেন, পশু চিকিৎসায় বিশেষ করে গরুর চিকিৎসায় ব্যবহার হওয়া দুটি ওষুধ ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধের বহুল ব্যবহারের ফলেই শকুন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়া থেকে। 

১৯৭০ সালের শকুন শুমারি অনুযায়ী, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ৫০ হাজারের মতো শকুন ছিল। বাংলাদেশে ২০০৮-০৯ সালে চালানো শুমারিতে দেখা যায়, শকুনের সংখ্যা নেমে আসে ১ হাজার ৯৭২টিতে। এর কয়েক বছর পর ২০১১-১২ সালে শকুনের সংখ্যা আরও কমে দাঁড়ায় ৮১৬টিতে। 

শকুন রক্ষায় সরকার এবং আইইউসিএন বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১৪ সালে দুটি অঞ্চলকে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করা হয়। প্রথমটি সিলেট, ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু অংশে। দ্বিতীয়টি খুলনা, বরিশাল এবং ঢাকা বিভাগের কিছু অংশ মিলে মোট সাড়ে ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাকে শকুনের জন্য নিরাপদ ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া আইইউসিএনের সঙ্গে সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ২০১৫ সালে শকুনের প্রজনন সময়ের জন্য দুটি ফিডিং সেন্টার স্থাপন করা হয়। একটি হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে এবং অন্যটি সুন্দরবনে। ২০১৬ সালে অসুস্থ এবং আহত শকুন উদ্ধার ও পুনর্বাসনের জন্য দিনাজপুরের সিংড়ায় একটি শকুন উদ্ধার এবং পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। 

৯-১০ বছর ধরে দেশে বাংলা শকুনের সংখ্যা প্রায় একই রকম থাকাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বন্য প্রাণী গবেষক সীমান্ত দীপু। তিনি এক যুগের বেশি সময় ধরে শকুন নিয়ে গবেষণা করছেন। বন বিভাগ ও আইইউসিএন পরিচালিত শকুন সংরক্ষণ প্রকল্পের মুখ্য গবেষক সীমান্ত দীপু সমকালকে বলেন, আমরা শকুনের শুমারি করেছি। শকুন রক্ষায় আমাদের সব কার্যক্রম চলমান আছে। সরকার দেশে গরুতে কিটোপ্রোফেনজাতীয় ক্ষতিকর ওষুধ প্রয়োগ নিষিদ্ধ করেছে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে শকুনের অপারেশ কার্যক্রম শুরু হয়। এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত আমাদের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। কারণ শকুন যেন আমাদের দেওয়া খাবারের ওপর নির্ভর হয়ে না যায়। প্রজনন মৌসুম সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত খাবার দেওয়া হয়। ১৭ অক্টোবর থেকে দুই সপ্তাহ আমরা শকুনের ট্র্যাকিং করবো। তিনি বলেন, ২০১১ সাল থেকে আমরা চেষ্টা করছি শুকুনের সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখতে। এটা আামাদের বড় সফলতা। নেপাল ও ভারত শুকুন রক্ষায় আমাদের পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। আমাদের দেখাদেখিতে তারাও আমাদের মতো কার্যক্রম চালাচ্ছে।  

রেমা-কালেঙ্গা ও সুন্দরবনের পর পাবনার বেড়ার ওই বাগান দেশে বাংলা শকুনের তৃতীয় কলোনি। সেখানে ১৫-২০টি বাংলা শকুন আছে। বনাঞ্চলের বাইরে লোকালয়ে দেশে একসঙ্গে এত বেশি শকুন কোথাও দেখা যায় না। মহাবিপন্ন এই পাখিগুলোকে বাঁচাতে সম্প্রতি একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, কেউ পাখিগুলোকে বিরক্ত করবে না। ওদের নিরাপদ খাবার সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেন, ২০১০ সালে দেশব্যাপী শকুনের জন্য ক্ষতিকারক ঔষধ ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে আমরা যে মাইলফলক অর্জন করেছি, তা বিশ্ব সংরক্ষণ সম্প্রদায়ের কাছেও একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। গত বছর কিটোপ্রোফেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রণীত ১০ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ শকুন সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনাকে অগ্রাধিকার দিয়েই প্রাণীটি সংরক্ষণে বর্তমানে সব ধরনের কার্যক্রম চলছে।

আরও পড়ুন

×