চেয়ারম্যান ‘কাঠের পুতুল’ এমপি-ইউএনও সর্বেসর্বা

.
অমিতোষ পাল
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০১:২২ | আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৯:১০
উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বসতে নেতারা যে এত উতলা, আদতে ওই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এলাকায় ‘কাঠের পুতুল’! জনগণের ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে প্রত্যক্ষভাবে জনগণেরই কল্যাণ করতে পারছেন না তারা। এলাকার উন্নয়নে তারা পান না সরকারি কোনো বরাদ্দ। স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারাই (ইউএনও) এলাকার সর্বেসর্বা। উপজেলার প্রতিটি উন্নয়নকাজ হয় কমিটির মাধ্যমে। চেয়ারম্যানরা কমিটির সভাপতি থাকলেও উপদেষ্টা করা হয় স্থানীয় এমপি আর ইউএনওকে। ফলে কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে চেয়ারম্যানদের প্রস্তাব অনেক ক্ষেত্রে ধোপে টেকে না!
উপজেলা চেয়ারম্যানরা মাস গেলে ভাতা পান মাত্র ১০ হাজার টাকা। ভাইস চেয়ারম্যানরা আরও কম– ৭ হাজার ৫০০। ভাইস চেয়ারম্যানরা ভাতার বাইরে আর কিছু না পেলেও চেয়ারম্যান হাঁকাতে পারেন একটি জিপগাড়ি; সঙ্গে চালক আর মাসে ২০০ লিটার জ্বালানি।
উপজেলা পরিষদ আইন ঘেঁটে দেখা গেছে, উপজেলা পরিষদের মূল কাজ ১৭টি, সঙ্গে ৩৮ রকমের দায়িত্ব। এতে চেয়ারম্যানের ১৩টি, ভাইস চেয়ারম্যানের ১২টি আর মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের ১৩টি দায়িত্ব বণ্টন করা আছে। এর মধ্যে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা রাখা, যোগাযোগ ও ভৌত অবকাঠামো, কৃষি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ, যুব ও ক্রীড়া, সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশু, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং সংস্কৃতির উন্নয়ন। এসব কাজে প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্থানের ক্ষমতা উপজেলা পরিষদের হাতে না থাকায় তারা কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেন না। ফলে উপজেলা পরিষদের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
পরিষদের চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানরা বলছেন, এই পরিষদ থাকার চেয়ে না থাকাই সরকারের জন্য লাভজনক। উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত হয়ে জনগণের কল্যাণে ভূমিকা রাখা যায় না। ইউএনও এবং স্থানীয় এমপিরা সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ জনপ্রতিনিধিদের।
আর স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাংবিধানিকভাবে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরাই সবকিছু পরিচালনার নিয়ন্ত্রক হওয়ার কথা থাকলেও তা শুধু কাগজে-কলমে। পরিষদের কার্যকারিতা নেই। পরিষদ টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে সরকারি দল তাদের স্থানীয় নেতাদের পুনর্বাসন ও তাদের ফায়দা লোটার সুযোগ করে দিচ্ছে। এতে জনগণ কোনো সুফলই পাচ্ছে না।
গেল রোববার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম প্রশ্নোত্তর পর্বে সংসদকে জানান, নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের জন্য আবারও প্রত্যেক এমপিকে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেবে সরকার। এ টাকা দিয়ে তারা নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে কাজ করবেন। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনেও উন্নয়নকাজের জন্য সরকার বিভিন্ন সময় এ রকম বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তবে উপজেলা পরিষদে এমন বরাদ্দ নেই বললেই চলে। তবু উপজেলায় ভোট করতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন স্থানীয় নেতারা।
উপজেলায় নির্বাহী ক্ষমতা থাকার কথা চেয়ারম্যানের হাতে। আর সাচিবিক দায়িত্ব ইউএনওর। তবে নির্বাহী ক্ষমতা সব সময় থেকেছে ইউএনওর হাতেই। এ প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বর দুমকী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদসহ পাঁচ জনপ্রতিনিধি আদালতে মামলা করেন। সেই মামলায় গত ২৯ মার্চ হাইকোর্ট ইউএনওদের সাচিবিক দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেন। এরপর ইউএনওদের পক্ষ থেকে আপিল করলে সেটি সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।
তাদের মনে ক্ষোভের আগুন
৯টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। জনগণের ভোটে জিতে হিরো হলেও বাস্তবে ‘জিরো’ থেকে গেছেন তারা। এ নিয়ে সবার মনে ক্ষোভের আগুন। তবু এবারও ভোটের মাঠ ছাড়বেন না কেউই। আবার ভোটযুদ্ধে নামবেন।
নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মইনুল হক উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতিও। বারহাট্টা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন আজাদ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহিনুর আক্তার শায়লা উপজেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি।
চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মইনুল হক বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বলতে কিছু নেই। বলতে পারেন, চেয়ারম্যান একজন ব্রোকার বা তদবিরকারী। আর চেয়ারম্যান যেখানে জিরো, সেখানে ভাইস চেয়ারম্যানরা তো ট্রিপল জিরো। প্রশ্ন উঠতে পারে, এর পরও নির্বাচন করেন কেন? কোনো জায়গা নেই। তাই এক জায়গায় বসে থাকা।’ তিনি আরও বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন ইউএনও। কোনো কিছু করতে হলে তাদের বলতে হয়। উপজেলা পরিষদ যেভাবে চলছে সেটা মানহানিকর। ১ লাখ ৭৫ হাজার ভোটারের প্রতিনিধি হয়ে একটি কাজের জন্য যদি ইউএনওকে অনুরোধ করতে হয়, তাহলে কী হলো? পৌরসভা ও ইউনিয়নে বরাদ্দ দেয়, উপজেলার জন্য বরাদ্দ নেই। ইউনিয়ন থেকে যদি বরাদ্দ কিছু রাখা যায়, তা-ই। এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) যে বরাদ্দ আছে, তা বছরে ৫০ লাখ টাকাও নয়। পানি, কৃষি, এলজিইডির যেসব কাজ হয়, এর সঙ্গেও উপজেলা পরিষদের কোনো সংযোগ নেই।’
১৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলা চেয়ারম্যান আইউব হোসেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার সালমুন আহম্মদ ডন উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কাজী মারজাহান মিতু জেলা যুব মহিলা লীগের সহসভাপতি। মারজাহান মিতু বলেন, ‘এত বড় একটা উপজেলায় চেয়ারম্যানের কোনো ক্ষমতা নেই। ভাইস চেয়ারম্যান তো ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা। আমাদের কোনো গাড়ি নেই, কোনো দায়িত্ব নেই। ইউপি চেয়ারম্যান, ইউএনও এবং এমপি যা করবে, তা-ই।’
তিনি বলেন, ‘১৭টি দপ্তর রয়েছে। দপ্তরগুলো কোনো মিটিং করে না। করলেও আমাদের ডাকে না। অথচ আমি নাকি সভাপতি। কখনও বলে একটা সইয়ের দরকার। সই নিয়ে চলে আসি। আবার কখনও মাসিক মিটিংয়ে একেবারে অনেক সই নিয়ে নেয়। পাঁচ বছর ধরে এটাই তো দেখছি।’ আবারও নির্বাচন করবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘করব। কারণ, যে কোনো দপ্তরে ফোন তো করতে পারব। অনেক সময় পাবলিকরে ঘুরায়। একটু তদবির করে যদি বলি– কাজটা দেখেন তো; তখন হয়তো একটু উপকার পায়। এ ছাড়া কিছু না।’
৫ লাখ ৫৩ হাজার ভোটার অধ্যুষিত নরসিংদী সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়া সদর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক আহ্বায়ক। ভাইস চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন ভূঁইয়া সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শাহিদা বেগম সদর থানা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
ভাইস চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা হলাম ধুয়া। সাঝের লাঠি। কাজকর্মের কিছুই না। সবকিছুই এমপি ও ইউএনও করেন। আমাদের কথায় কোনো কাজ হয় না। আমাদের ক্ষমতায়নের বিষয়ে আদালতে তিনটি মামলা আছে। হাইকোর্ট থেকে প্রতিটি মামলায় আমাদের পক্ষে রায় এসেছে। সেই রায় আমলারা মানে না। এই উপজেলা পরিষদ রেখে কোনো লাভ নেই, সরকারের লস।’
কে কী বলছেন
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সাংবিধানিক রীতি অনুযায়ী জনগণের প্রতিনিধির শাসন চলার কথা। সে হিসেবে ইউএনও থাকবেন উপজেলা পরিষদের অধীনে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশনের জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতায়ন করার কথা। বাস্তবে উপজেলা পরিষদকে ক্ষমতায়ন একেবারেই করা হয়নি; বরং যাদের দায়িত্ব আইন প্রণয়ন করা, সেই এমপিরাই ক্ষমতায়িত হয়েছে। তবু উপজেলায় অনেকেই নির্বাচন করতে চান। কারণ, যে কোনো পদ-পদবি পাওয়া মানেই ফায়দা নেওয়ার সুযোগ পাওয়া। এসবের সঙ্গে ক্ষমতার জাদুর কাঠিও যুক্ত। এসব পদে বসে তদবির করতে পারে, মানুষের জন্য কিছু করতে না পারলেও নিজের আখের গোছাতে পারে। তারা অনেক অন্যায় কাজ করেও পার পায়। এই ফায়দাভিত্তিক রাজনীতির সংস্কৃতিই চলছে।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ক্ষমতা বেশি প্রসঙ্গে বরিশালের আগৈলঝাড়ার ইউএনও ফারিহা তানজিন বলেন, ‘আইন ও নিয়ম অনুযায়ী চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব নির্ধারণ করা আছে। ১৭টা স্ট্যান্ডিং কমিটি আছে, যেগুলোর সভাপতি তারা। তাদের প্রতিমাসে মিটিং করার কথা। সরকার প্রদত্ত যে দায়িত্ব আছে, যদি সঠিকভাবে পালন করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন তাদের দায়িত্বের ব্যাপ্তি কতটা। কাজের পরিধিটা জেনে যদি কাজ করেন, তাহলে উপজেলা পরিষদকে আরও কার্যকর করার সুযোগ রয়েছে।’
এসব বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম এমপি বলেন, বর্তমান পদ্ধতিতেই উপজেলা পরিষদগুলোকে জনগণের কল্যাণে কাজ করতে হবে। তারা সে কাজটি অনেকটাই করছে। তাদের নাগরিকবান্ধব প্রকল্প নিতে হবে। তাহলে উপজেলা পরিষদ আরও কার্যকর করা সম্ভব হবে।
- বিষয় :
- জনপ্রতিনিধি