ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

‘কাল’ হচ্ছে খাল দখল

‘কাল’ হচ্ছে খাল দখল

ছবি-সমকাল

 অমিতোষ পাল

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৪ | ০০:৫১ | আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৪ | ০৯:২১

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় গড়ে ওঠা স্বপ্নধরা হাউজিং এস্টেটের ৭ নম্বর সড়কের শেষ প্রান্তে গেলেই দেখা যায় মৃতপ্রায় রামচন্দ্রপুর খাল। এক সময় খালটিতে ১২ মাসই নৌকা-ট্রলার চলত। সেই খালের পাড় ঘেঁষে সড়কটির দক্ষিণ পাশে একটি ৯ তলা বাড়ি উঠে গেছে। তার বিপরীত পাশে নির্মাণাধীন আরেকটি ৯ তলা ভবনের তিন তলা পর্যন্ত কাজ শেষ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মানচিত্রে দেখা যায়, দুটি ভবনই রামচন্দ্রপুর খালের অংশবিশেষ ভরাট করে গড়ে উঠেছে। 

সরেজমিন দেখা যায়, ৯ তলা বাড়িটির সামনে টু-লেট টানানো। বাড়ির মালিক মন্টু আক্তারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে জানান, তিনি বাসায় থাকেন না। সিটি করপোরেশনের লোকজন দারোয়ানকে অবৈধ দখলের কথা বলে গেছে। দারোয়ান তাঁকে জানিয়েছেন। এ নিয়ে তিনি কোনো কথা বলবেন না। 

খালটি উদ্ধারে অভিযান শুরুর পর নির্মাণাধীন ভবনটির কাজও বন্ধ। ভেতরে ইট-রড-পাথর প্রভৃতি নির্মাণসামগ্রীর স্তূপ। জরুরি যোগাযোগের জন্য বাইরের দেয়ালে একটি ফোন নম্বর লেখা। ফোনে যোগাযোগ করলে নুরুন নবী নামের একজন বলেন, কয়েকজন মিলে ভবনটি তৈরি করছেন। তিনি ওই ভবনের কেয়ারটেকার। মালিকদের ফোন নম্বর দিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে রামচন্দ্রপুর খালে অভিযান শুরু করেছে ডিএনসিসি। এ খালের পাড়ের ২২টি বহুতল ভবন কমবেশি জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে। এই অবৈধ দখল এখন কাল  হয়ে দাঁড়িয়েছে ভবন মালিকদের জন্য। এরই মধ্যে এ রকম  ছয়টি বহুতল ভবনের অংশবিশেষ ও বেশ কিছু অস্থায়ী অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

অবশ্য অবকাঠামো ভাঙার শিকার ব্যক্তিদের অভিযোগ, কোনো রকম নোটিশ ছাড়াই তাদের ভবনে বুলডোজার চালানো হয়েছে। এমনকি ভবনের যেটুকু খালের অংশ বলে ডিএনসিসি দাবি করছে, তার চেয়ে বেশি অংশ গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। 

ডিএনসিসি বলছে, কৌশলগত কারণে তারা এমনটা করছে। খাল উদ্ধার অভিযানে তারা কোনো আগাম নোটিশ দেবে না। নোটিশ দিলে দখলকারীরা আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন। তাতে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হবে। 

সংস্থাটির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, সিএস এবং আরএস ম্যাপ অনুযায়ী রামচন্দ্রপুর খালটির প্রশস্ততা কোথাও ৫০ ফুটের কম নয়। এমনকি ১২০ ফুট পর্যন্ত রয়েছে। অথচ দুই পাশের দখলদারদের চাপে অনেকাংশে খাল প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। 

২০২২ সালে সেনাবাহিনীর সহায়তায় খালটির সীমানা চিহ্নিত করে ডিএনসিসি। সে সময় খুঁটিও পুঁতে দেওয়া হয়। তবে তা গায়েব হয়ে গেছে। এখন অনেকেই খালের জমি কমবেশি দখল করে বাড়ি বানিয়েছে। এ অবস্থায় নতুন করে সীমানা চিহ্নিত করে অভিযান চালানো হচ্ছে। ভবনের যে অংশ খালের মধ্যে পড়েছে, তা লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। 

‘ফিউচার টাউনের’ ই-ব্লকের ২ নম্বর রোডের বাড়িটিরও অংশবিশেষ খালের মধ্যে পড়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, খালপাড়ের কিছু জায়গা ভরাট করে একটি দোকান তৈরি করেছেন বাড়ির মালিক। পাশে খালপাড়ের দিকে দেয়াল দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাড়িরও কিছু অংশ খালের জায়গায় পড়েছে। 

স্বপ্নধরা হাউজিংয়ের ৬ নম্বর রোডের ১৩০ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৯ তলা ভবনেরও কিছু অংশ খালের অংশে পড়েছে। বাড়িটির কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। পার্শ্ববর্তী আরেকটি বাড়ির মালিক রহমত আলী জানান, আগে এই নদীতে নৌকা ও ট্রলার চলতে দেখেছেন। চোখের সামনেই খালের পানি হারিয়ে গেল। 

শাহজালাল হাউজিংয়ের ৪১/১ নম্বর বাড়িটিরও কিছু অংশ খালের মধ্যে পড়েছে। বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক রাজু জানান, খালের দিকে শুধু একটি ছোট টিনডেশ ছিল। তা ভেঙে দিয়েছে সিটি করপোরেশন। সরেজমিন দেখা যায়, ভবনটির আরও কিছু অংশ লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করা। সেই অংশটুকু ভাঙা হয়নি। 

স্বপ্নধরা হাউজিংয়ের ২ নম্বর রোডের ৫১ নম্বর হোল্ডিংয়ের ‘আশীর্বাদ’ নামক বাড়ির একটি বড় অংশ খালের জায়গায়। মূল ভবনটি ছাড়াও খালের পাড়ে আরেকটি ছোট বাড়ি তৈরি করেছিলেন মালিক ডা. নুরুন নাহার। সম্প্রতি ডিএনসিসি ছোট বাড়িটি সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেয় এবং বুলডোজার দিয়ে আশীর্বাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভেঙে দেয়। 
ডা. নুরুন নাহার অবশ্য দাবি করেন, তিনি যেটুকু জায়গা কিনেছিলেন, তার মধ্যেই বাড়ি বানিয়েছেন। আগের দিন মার্কিং করল, পরদিনই বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দিয়ে গেল। তারা কোনো কাগজপত্রই দেখল না। 

অভিযানে ভাঙা পড়া ১০ তলা ভবনের মালিক মো. জাফর দাবি করেন, সিটি করপোরেশনের নকশা অনুসারেই একটি মাত্র কলাম পড়েছিল খালের জায়গায়। তবে তার দুটি কলাম ভেঙে ফেলা হয়েছে। এতে পুরো ভবনটিই এখন হুমকির মুখে।  

অবশ্য খাল উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্বদানকারী ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতাকাব্বির আহমেদ বলেন, যে অংশটুকু খালের মধ্যে পড়েছে, তারা শুধু সেই অংশই ভেঙে দিচ্ছেন। এর বাইরে তারা যাচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রে দখলদারকে বলা হচ্ছে নিজ উদ্যোগে অবৈধ অংশ অপসারণের। 

ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘খাল উদ্ধারে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছি। খালের সীমানায় কোনো স্থাপনা থাকবে না। খাল দখলমুক্ত করতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। ময়লা ও দখলমুক্ত করে রাজধানীর খালগুলো আগের রূপে ফেরানো হবে। এই অভিযান চলমান থাকবে।’

একের পর এক খাল দখল ও অভিযান প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, যেসব দেশে সুশাসন আছে, সেখানে খাল ভরাট করে কেউ ঘরবাড়ি বানায় না। আমাদের দেশে বানায়। কারণ ক্ষমতাবানরা মনে করেন সিটি করপোরেশন বা রাজউককে ম্যানেজ করা যাবে। এভাবে একজনকে দেখে আরেকজন উৎসাহিত হন। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এই বার্তা দিতে হবে যে, এ রকম আর করা যাবে না। তাহলে এটা বন্ধ হবে। 

তিনি বলেন, এই খালের কাস্টডিয়ান (জিম্মাদার) হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছে, তাদেরও শাস্তি দিতে হবে। কারণ যখন ভরাট করেছে, তখন কাস্টডিয়ানরাও হয়তো তাদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে সুযোগ করে দিয়েছে। এ জন্য আগের কাস্টডিয়ানদের শাস্তি দিলে এখন যারা দায়িত্বে আছে, তারাও আর এই সুযোগ দেবে না।

 

আরও পড়ুন

×