প্রতিযোগিতার অভাবে সহিংসতা কম হয়েছে
নির্বাচন নিয়ে এনডিআই ও আইআরআইয়ের প্রতিবেদন

এনডিআই এবং আইআরআইর লোগো
কূটনৈতিক প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৪ | ২০:১০
• ক্ষুণ্ন হয়েছে নির্বাচনের গুণগত মান
• অবনতি হয়েছে নাগরিক, বাক ও সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা
• নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকারি সংস্থা অসমভাবে নির্বাচনী বিধি প্রয়োগ করেছে
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশব্যাপী কার্যকর নির্বাচনী প্রতিযোগিতার অনুপস্থিতি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির বিষয়ে সরকারের বাড়তি মনোযোগের কারণে অন্যান্য নির্বাচনের তুলনায় সহিংসতার ঘটনা কম হয়েছে। এর পাশাপাশি নাগরিক অধিকারের চর্চা, বাক স্বাধীনতা ও সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতার চর্চা সংকুচিত হওয়াসহ নানা কারণে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের গুণগত মান ক্ষুণ্ন হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মূল্যায়ন করতে আসা যুক্তরাষ্ট্রের দুই নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিআই) ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) তাদের কারিগরি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে এমনটাই তুলে ধরেছে। রোববার আইআরআইর ওয়েব সাইটে চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
এনডিআই ও আইআরআই তাদের প্রতিবেদনে বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনী সহিংসতার বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে। ভবিষ্যতে নির্বাচনে সহিংসতার ঝুঁকি প্রশমন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আইআরআই ও এনডিআই’র নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, সরকারের নির্বাহী ও আইন বিভাগ, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও অন্যান্য অংশীজনদের কাছে বেশ কিছু সুপারিশ রেখেছে।
বাংলাদেশে কাজ করার সময় এনডিআই ও আইআরআই প্রতিনিধি দল অবগত হয়েছেন যে, ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময়কাল, প্রচারের সময়কাল, নির্বাচনের দিনসহ অন্যান্য সময়ে, পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোর সরাসরি ও অনলাইনে সহিংসতা কম হয়েছে। প্রাথমিকভাবে দেশব্যাপী কার্যকর নির্বাচনী প্রতিযোগিতার অনুপস্থিতির কারণে এবং দেশের নিরাপত্তায় সরকারের বাড়তি নজর দেয়ায় এটি ঘটেছে। এরপরও জানুয়ারির নির্বাচনের গুণগত মান ক্ষুণ্ন হয়েছে।
রাষ্ট্র, শাসক দল, এবং বিরোধীদের সহিংসতা, সেই সঙ্গে একটি প্রাক-নির্বাচন পরিবেশ যেখানে রাজনৈতিক মেরুকরণ, রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মাঝে সহিংসতা, নাগরিক স্বাধীনতার সংকোচন, এবং বাক স্বাধীনতা ও সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতার অবনতি কারণে এমনটা হয়েছে।
এনডিআইয়ের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক মনপ্রীত সিং আনন্দ বলেন, এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের ভবিষ্যতে আরও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য একটি মূল্যবান পথনকশা হিসেবে অবদান রাখবে। অহিংস রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল, সরকার এবং নাগরিক সমাজসহ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডল জুড়ে নেতাদের নির্বাচনী রাজনীতির নিয়ম, অনুশীলন এবং নিয়মগুলির সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।
আইআরআই’র এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক জোহানা কাও বলেন, নির্বাচনে সহিংসতা নাগরিকদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একটি প্রধান প্রতিবন্ধক। বাংলাদেশের নির্বাচনকে পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক করতে হলে সব পক্ষকে অহিংস রাজনীতিকে প্রাধান্য দিতে হবে।
নির্বাচনকালীন সময়ে বাংলাদেশ সরকার নিরাপত্তা বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। নির্বাচনী নিরাপত্তা বাজেট বাড়ানো, দীর্ঘ সময়কালব্যাপি বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েনসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকি করার জন্য অ্যাডহক সমন্বয় ইউনিট গঠনের মতো কাজগুলো করা হয়েছে। তারপরও অনেক অংশীজন অভিযোগ করেছে যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুবিধা দিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা পরিষেবা এবং বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান বারবার অসমভাবে নির্বাচনী বিধি প্রয়োগ করেছে। বিরোধী দলের সদস্যদের গ্রেপ্তার এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সরকার ব্যাহত করেছে, যা ন্যায়সংগত ছিল না। এ কারণে নির্বাচনকালীন সময়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সম্পর্কে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ধারণা তৈরি হয়েছে।
প্রতিযোগিতার অভাবে নির্বাচনে সহিংসতা কম হলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফাঁক ও ঝুঁকি রয়ে গেছে। এ জন্য সংস্থা দুটি মোট ২৮টি সুপারিশ করেছে। সেগুলো হলো– অহিংস নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সকল পক্ষকে নির্বাচনি রাজনীতির নিয়ম অনুশীলন এবং নিয়মগুলো সংস্কারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত।
নিরাপত্তা কর্মীদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রতিষ্ঠা করা এবং সহিংসতা সম্পর্কিত মামলাগুলোর দ্রুত ও স্বাধীন বিচারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা। সেই সঙ্গে আইনি কাঠামো হালনাগাদ করার মত নতুন ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচনের স্বাধীনতা ও তদারকি উন্নত করা যেতে পারে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ও সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ সরকারের উচিত বিদ্যমান আইনগুলোর প্রয়োগ উন্নত করা। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং সহিংসতা প্রশমন প্রচেষ্ঠায় সরকারকে পরামর্শ দিতে নাগরিক সমাজের ভূমিকা থাকা উচিত। রাজনৈতিক নেতাদের উচিত নিজ দলে অহিংসার সংস্কৃতি গড়ে তোলা। সেই সঙ্গে নির্বাচনী সহিংসতার জন্য বিশেষত সংখ্যালঘু ও নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় জন্য দায়ী নিজ দলের রাজনৈতিক সদস্যদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে, চলাকালীন ও পরে সম্ভাব্য নির্বাচনী সহিংসতা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশে একটি কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিনিধি দল পাঠায় এনডিআই ও আইআরআই। বাংলাদেশে অবস্থানের সময় এনডিআই ও আইআরআইয়ের পাঁচজন দীর্ঘমেয়াদি বিশ্লেষক নির্বাচন ও সরকারি কর্মকর্তা, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংবাদিক, নাগরিক সমাজের সংগঠনসহ যুবক, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি স্বীকৃত আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আর কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিনিধি দল পাঠানোর আগে গত বছরের ৮ থেকে ১১ অক্টোবর একটি যৌথ প্রাক-নির্বাচনী মূল্যায়ন মিশন পাঠায় এনডিআই ও আইআরআই।