কমানোর সাড়ে তিন মাস পর বাড়ল হার্টের রিংয়ের দর

ফাইল ছবি
তবিবুর রহমান
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২৪ | ০০:২১
ব্যবসায়ীদের আন্দোলনের মুখে কমানোর সাড়ে তিন মাসের মাথায় আবারও বাড়ল হৃদরোগের জরুরি চিকিৎসায় ব্যবহৃত হার্টের রিংয়ের (স্টেন্ট) দাম। গতকাল মঙ্গলবার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) দেওয়া এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়। নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, রিংপ্রতি দাম ২ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে দাম বাড়ানোর বিষয়ে কিছুই জানেন না দাবি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের। যদিও দাম বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপনে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্বাক্ষর দেখা গেছে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে ডিজিডিএ কর্মকর্তারা এ কাজ করছেন। যে কারণে গোপনে কারসাজি করে রিংয়ের দাম বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে হৃদরোগ চিকিৎসার খরচ কমাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা হার্টের রিংয়ের দাম সমন্বয় করতে গত বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দেন। সে চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে ডিজিডিএ দাম কমাতে উদ্যোগ নেয়। গত ১২ ডিসেম্বর রিংয়ের নতুন দাম বেঁধে দেয় সরকার। তবে আমদানিকারকদের বড় একটি অংশ সরবরাহ বন্ধ রাখায় দাম নিয়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ইউরোপীয় স্টেন্ট আমদানিকারকরা দাম পুনর্নির্ধারণের দাবি জানিয়ে হাসপাতালগুলোকে চিঠি দেয় তাদের রিং ব্যবহার না করতে। পরে দাম পুনর্নির্ধারণের দাবিতে হাইকোর্টে রিটও করে ইউরোপীয় আমদানিকারকরা। তবে দাম পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে ডিজিডিএর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ১০ জানুয়ারি রিট প্রত্যাহার করে নেন তারা। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য সচিব জাহাঙ্গীর আলমের সভাপতিত্বে এক বৈঠকে সরকার নির্ধারিত দামেই হার্টের রিং বিক্রির নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে সে সিদ্ধান্তে অটল থাকল না সরকার।
২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ঔষধ প্রশাসন অ্যালেক্স প্লাস কার্ডিয়াক কোম্পানির রিংয়ের দাম ৫৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু সাড়ে তিন মাস পর গতকাল সেই রিংয়ের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। ডিসেম্বরে আলটিমাস্টারের স্টেন্টের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬০ হাজার টাকা। নতুন করে এখন সেটির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৬ হাজার টাকা। ৫৫ হাজার টাকার ডাইরেক্ট স্টেন্ট সিরোর নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৬ হাজার টাকা। ৫৬ হাজার টাকার ওমেগা হেলথ কেয়ার রিংয়ের দামও ৯ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৬৬ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিসেম্বরে বিজনেস লাইন কোম্পানির রিংয়ের দাম নির্ধারণ হয়েছিল ২০ হাজার টাকা। এটি বাড়িয়ে এখন ৩০ হাজার টাকা করা হয়েছে।
এ ছাড়া উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাডভান্সড মেডিটেক, এশিয়া প্যাসিফিক মেডিকেলস লিমিটেড, অ্যালায়েন্স মেডিকা, বিভা ইন্টারন্যাশনাল, বায়োভাসকুলার লিমিডেট, বিজনেস লিঙ্ক, কার্ডিয়াক কেয়ার লিমিটেড, কার্ডিয়াক সলিউশন লিমিটেড, কার্ডিওলাইন, কার্ডিনাল হেলথ কেয়ার, ডেলটা লিমিটেড, ইপিআইসি টেকনোলজিস, জেনেভিক হেলথ লিমিটেড, হার্ট কোয়াক লিমিডেট, দ্য হার্ট বি, আইএসপি ইন্টারন্যাশনাল, লাইফলাইন ইন্টারন্যাশনাল, মেডট্রনিক বাংলাদেশ প্রাইভেট মিলিটেড, মেডিগ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেড, এমআর ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল, ওশান লাইফ, ওমেগা হেলথ কেয়ার, দ্য স্পন্দন লিমিটেড, ইউনিমেড লিমিটেড, ইউনিট্রেড লাইফ সায়েন্স লিমিটেডের রিংয়ের দাম সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ বাড়িয়েছে ডিজিডিএ।
গতকাল উৎপাদনকারী ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানের ২৩ ধরনের হার্টের রিংয়ের দাম নির্ধারণ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত রিংয়ের দাম কমানো বা বাড়ানো হয়নি। ডিজিডিএ মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে মঙ্গলবার বলা হয়, বাংলাদেশে ইউরোপীয় এবং অন্যান্য দেশের হার্টের রিংয়ের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, প্রিন্সিপাল স্থানীয় প্রতিনিধি এবং ইন্টারভেনশন কার্ডিওলজিস্টদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির হার্টের রিংয়ের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। হার্টের রিংয়ের মূল্য হ্রাসে এটি ডিজিডিএর যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ডিজিডিএ নতুন নির্ধারিত দামের সঙ্গে তুলনা করেছে ২০২১ ও ২০২২ সালের রিংয়ের। কারণ সেই হিসাবে রিংয়ের দাম কমেছে।
এ বিষয়ে ডিজিডিএর পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, ‘হৃদরোগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসক ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে রিংয়ের দাম সমন্বয় হয়েছে। সব হাসপাতালে রিংয়ের দামের তালিকা টানিয়ে দিতে বলা হয়েছে, যাতে রোগী ও স্বজনরা নতুন দাম সম্পর্কে জানতে পারেন।’ রিংয়ের দাম তো বেড়েছে, কমছে বলছেন কেন– এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ২০২১ সালে যে দাম ছিল তার চেয়ে এখন অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ১২ ডিসেম্বর যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেড়েছে? এর কারণ বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে চাননি।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের একজন অধ্যাপক বলেন, হার্টের রিংয়ের দাম দুই দফায় কমার পর মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে এসেছিল। এখন আবার বাড়ানোয় জনগণের ওপরে প্রভাব পড়বে। রিংয়ের দাম বাড়ানো উচিত হয়নি।
দাম নির্ধারণ কমিটির সদস্য হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে হার্ট রিংয়ের দাম কমানো হলে ইউরোপীয় রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আদালতের দারস্থ হয়েছিল। রিটের মীমাংসা হওয়ার পর তাদের প্যারেন্ট কোম্পানিদের নিয়ে আমরা বসেছিলাম। ওই দামে রিং বিক্রি করলে ক্ষতি হচ্ছে জানিয়ে বলে, তাদের পক্ষে ওই দামে রিং সরবরাহ করা সম্ভব না। বাজারে ৫০ শতাংশ রিং সরবরাহ করে ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান আর ৫০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান। দাম না বাড়ানোয় তারা ধর্মঘট ডাকলে বাজারে সংকট তৈরি হয়েছিল। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি রিং দিয়ে রোগীদের সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব না। এ জন্য খুব অল্প পরিমাণে দাম বাড়ানো হয়েছে।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘হার্টের রিংয়ের দাম বাড়ানোর বিষয়ে আমি জানি না। কেন বাড়ানো হলো এ বিষয়ে খোঁজ নেব।’
- বিষয় :
- হার্টের রিং