ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

সেবা না দিয়ে বিল আদায়, বেপরোয়া প্রাইভেট ক্লিনিক

সেবা না দিয়ে বিল  আদায়, বেপরোয়া প্রাইভেট ক্লিনিক

ছবি-সমকাল

 তবিবুর রহমান

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৪ | ০০:৫৯ | আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৪ | ০৮:২২

গত ১২ মার্চ রাজধানীর মিরপুরে ডেল্টা হাসপাতালে ভর্তি হন সন্তানসম্ভবা শাহিনুর আক্তার। ওই দিনই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করেন তিনি। জন্মের পর নবজাতককে রাখা হয় নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (এনআইসিইউ)। জটিলতা না থাকায় ১০ ঘণ্টা পর ছাড়পত্র দেওয়া হয় মা-সন্তানকে। ক্যাশ কাউন্টার থেকে বিল ধরিয়ে দেওয়া হয় ৪৩ হাজার ১১৫ টাকার। বিল দেখে অবাক শাহিনুরের পরিবার! এত বিল কেন– জানতে চাইলে ডেল্টা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি হিসাব দাঁড় করায়, যার মধ্যে রয়েছে এনআইসিইউ বিল ১৩ হাজার ৪৭৫ টাকা, অপারেশন থিয়েটার (ওটি) বিল ৯ হাজার টাকা, বেড চার্জ ৪ হাজার ৮০০ টাকা এবং ডা. ফেরদৌস আরা সূচির পরামর্শ ফি ১৫ হাজার টাকা!

শাহিনুরের স্বজনরা জানান, ডা. ফেরদৌস আরা সূচি ওই দিন হাসপাতালেই আসেননি, অথচ তাঁর নামে বিল করা হয়েছে। অস্ত্রোপচার দরকার না হলেও ওটির বিল ধরা হয়েছে ৯ হাজার টাকা। ডেলটা হাসপাতালের বক্তব্য– ‘ডা. ফেরদৌস আরা পরামর্শ দিয়েছেন টেলিফোনে। তাই তাঁর নামে বিল হয়েছে।’ পুরো বিল পরিশোধ না হলে ছাড়পত্র দেওয়া হবে না– এমন কথাও বলা হয়। নিরুপায় হয়ে ধারদেনা করে বিল পরিশোধ করেন শাহিনুর। এ ঘটনায় হতভম্ব তাঁর স্বজন রাজিব আহমেদ। বিস্ময় প্রকাশ করে রাজিব বলেন, ‘ডা. ফেরদৌস আরা একবারও রোগীর কাছে এলেন না, অথচ তাঁর নামে ১৫ হাজার টাকা বিল করা হলো! কোন দেশে আছি?’

এই বিলের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে ডেল্টা হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপক আবুল বাশার সমকালকে বলেন, ‘যে ডাক্তারের অধীনে রোগী ভর্তি হন, তিনি তো সারাদিন হাসপাতালে থাকেন না, ফোনকলে পরামর্শ দেন। তাই তাঁর পরামর্শ ফি নেওয়া হয়। এটি হাসপাতালের নিয়ম।’ তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ডা. ফেরদৌস আরা সূচি।

ঘটনাটিকে সেবা না দিয়ে রোগীর কাছে ফি আদায়ের একটি দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন চিকিৎসাসেবা সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, রাজধানীসহ দেশের অনেক প্রাইভেট ক্লিনিকে ঘটছে এমন ঘটনা। চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অথচ এ ব্যাপারে কোনো তদারকি নেই!

চুয়াডাঙ্গার ইয়াসমিন বেগমের দেড় মাসের ছেলে মোহাম্মদের হার্টে জন্মগত ছিদ্র। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি তাকে নিয়ে রাজধানীর মিরপুরে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে আসেন ইয়াসমনি। শ্বাসকষ্ট থাকায় শিশুটিকে ঢাকায় আনা হয় অ্যাম্বুলেন্সে। ডাক্তাররা দেখে তাকে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) রাখার পরামর্শ দেন। কিন্তু ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে ওই সময় পিআইসিইউ ফাঁকা ছিল না। অ্যাম্বুলেন্সচালকের পরামর্শে তখন ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে সুপারম্যাক্স হেলথকেয়ার লিমিটেড হাসপাতালে যান ইয়াসমিন, তাঁর স্বামী ও বোন।

হাসপাতালের কাউন্টার থেকে বলা হয়, সেখানে ভর্তি হলে দৈনিক পাঁচ হাজার টাকা খরচ পড়বে। তবে বিল কিছুটা কমিয়ে রাখবে তারা। কিন্তু দু’দিন পর ইয়াসমিনের হাতে ৪৭ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়! এর মধ্যে রয়েছে সার্ভিস চার্জ চার হাজার টাকা, এনআইসিইউ বিল সাড়ে সাত হাজার টাকা (যদিও মনিটর ছিল না) এবং বেড ভাড়া ৯ হাজার টাকা। বিল দেখে অবাক ইয়াসমিনের পরিবার! জমি বিক্রি করে আনা টাকায় ওই বিল দিয়ে সন্তানের চিকিৎসা না করিয়েই ফিরে যায় চুয়াডাঙ্গায়। দু’দিন পর মারা যায় ছোট্ট মোহাম্মদ।

বিষয়টি নিয়ে পরে কথা হয় সুপারম্যাক্স হেলথকেয়ারের পরিচালক (অর্থ) মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী বিল নেওয়া হয়েছে। ঢাকা শহরে আমাদের চেয়ে কমে কেউ পিআইসিইউতে রোগী রাখতে পারবে না।’ সুপারম্যাক্স হেলথকেয়ারের মতো হাসপাতালে দু’দিন পিআইসিইউ ব্যবহারের বিল কোন নিয়মে ৪৭ হাজার টাকা হয়– এ প্রশ্নের উত্তর দেননি তিনি।

সরকারি ও বেসরকারি বিলে বিরাট ফারাক

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রোপচার ছাড়া অর্থাৎ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসবে নেওয়া হয় দেড় হাজার টাকা। অথচ বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালে এর খরচ ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। রাজধানীর স্কয়ার ও এভারকেয়ারের মতো হাসপাতালে এ সেবার জন্য নেওয়া হয় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। অন্য সেবার ক্ষেত্রেও সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের বিলে বিরাট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন– অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হলে সরকারি হাসপাতালে খরচ হয় আট হাজার টাকা, আর বেসরকারি হাসপাতালে দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকা। ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি সরকারি হাসপাতালে ১৫০ টাকা, বেসরকারি হাসপাতালে পাঁচ হাজার টাকা। ক্যান্সার শনাক্তে বায়োপসি পরীক্ষায় খরচ সরকারি হাসপাতালে ১৫০ টাকা হলেও বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয় ৩০ হাজার টাকা!
স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মানুষ বাড়ছে; কিন্তু স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়েনি। তাই যেখানে-সেখানে চিকিৎসা নিতে গিয়ে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্ররা। অসহায় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বেসরকারি ক্লিনিকগুলো রোগীর কাছে ‘গলাকাটা’ বিল আদায় করছে। এ ব্যাপারে যেন বেপরোয়া তারা। আবার এক শ্রেণির চিকিৎসক গোপন চুক্তির ভিত্তিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর কমিশন নিচ্ছেন। হাসপাতাল-ক্লিনিকভেদে এই কমিশন ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। কমিশনের লোভেই অনেক চিকিৎসক অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান। এমনকি পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে আনতে বাধ্য করেন। এই বাণিজ্যের কারণেও চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে।

নিয়ম কী বলে

দেশে হাসপাতাল-ক্লিনিকের সেবা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরকারি হাসপাতালে বিভিন্ন সেবার ফি অধিদপ্তর থেকেই নির্ধারণ হয়। তবে প্রাইভেট ক্লিনিকে সেবার মূল্য বেঁধে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। ৪২ বছর আগের এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে চলছে দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত। ১৯৮২ সালের ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স’ শীর্ষক ওই অধ্যাদেশ বাদ দিয়ে ২০১৮ সালে নতুন আইন করার উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেটি হয়নি। এ ছাড়া ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকগুলোর সেবার মূল্য তালিকা এবং ক্যাটেগরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেটিও এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।

কী বলছেন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘সরকারের মধ্যে থাকা স্বার্থান্বেষী মহলের কারণেই স্বাস্থ্যসেবা আইন ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ স্বার্থান্বেষী ওই মহলটি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মালিক।’ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে সেবার ফি নির্ধারণ করার মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

স্ত্রী ও প্রসূতিরোগ চিকিৎসকদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবির) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সালমা রউফ বলেন, ‘ফোনকলে পরামর্শ দিয়ে রোগীর কাছ থেকে ফি রাখার বিষয়টি নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। আমি নিজে সন্তান প্রসবের সময় উপস্থিত না থাকলে পরামর্শ ফি রাখি না।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসানও মনে করেন, সেবা না দিয়ে পরামর্শ ফি নেওয়ার সুযোগ নেই। এমন অভিযোগ থাকলে হাসপাতাল পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি। সাত দিনের মধ্যে জবাব না দিলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘বেসরকারি ক্লিনিক বা হাসপাতালে সেবার মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার এখতিয়ার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেই।’

প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগীর কাছে ইচ্ছামতো ফি রাখার বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আইনি কাঠামো ছাড়া বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় পরিস্থিতি এমন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। তাই বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে সংস্কার জরুরি।’ এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের তদারকির অভাব রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়াও মনে করেন অনিয়ম বন্ধে তদারকি বাড়ানো জরুরি। তিনি বলেন, ‘আমরা সব হাসপাতালে মানসম্মত সেবা দেওয়ার পক্ষে। সেবা না দিয়ে টাকা নেওয়া অপরাধ। তবে এটি বন্ধে সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে।’ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সেবার মানের ভিত্তিতে ক্যাটেগরি করে ফি নির্ধারণে সরকারের সঙ্গে একমত রয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সিলগালা প্রতিষ্ঠান আবার চালু

হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অনিয়ম বন্ধে মাঝেমধ্যে অভিযানে নামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয় না! নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন দায়িত্ব গ্রহণের পর হাইকোর্টের নির্দেশে ১ হাজার ২৭টি অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা করেন। অভিযান চালিয়ে পাঁচশর বেশি অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু এরই মধ্যে তার অনেকটি আবার চালু হয়েছে।

সেবার মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হবে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন সমকালকে বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে চিকিৎসায় অতিরিক্ত ফি আদায়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। স্বাস্থ্যসেবায় শৃঙ্খলা ফেরাতে নিবন্ধনহীন হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সেবার মূল্যও নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।’ 

আরও পড়ুন

×