ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

২০২৩-২৪ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট পাস

পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার দাবি সংসদে

জনতা ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা ঋণ ও এক্সিম ব্যাংকের কয়েকশ কোটি টাকা মওকুফ নিয়ে প্রশ্ন

পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার দাবি সংসদে

ফাইল ছবি

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৪ | ১৮:৩৮ | আপডেট: ১০ জুন ২০২৪ | ২১:২০

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৩৭ হাজার ৮১৭ কোটি ৪০ লাখ ৫৭ হাজার টাকার সম্পূরক বাজেট সংসদে পাস হয়েছে। গতকাল সোমবার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ‘নির্দিষ্টকরণ (সম্পূরক) বিল-২০২৪’ সংসদে উত্থাপনের পর বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়।

এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মঞ্জুরি দাবির ওপর ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা আর্থিক খাতে বিভিন্ন অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে সমালোচনা করেন। তারা পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি পাচারকারীদের চিহ্নিত করার দাবি জানান।

সংসদ সদস্যদের এই সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘অনিয়মের যেসব কথা বলা হয়েছে, সেগুলো অনেকটা ঢালাও অভিযোগ।’ পরে কণ্ঠভোটে ছাঁটাই প্রস্তাবগুলো নাকচ হয়। সম্পূরক বাজেটে ২০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মঞ্জুরি দাবির ওপর ৬৬টি ছাঁটাই প্রস্তাব দেওয়া হলেও আলোচনা হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ওপর। বাকি প্রস্তাবগুলো আলোচনা ছাড়াই ভোটে দেন স্পিকার।

আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আর্থিক বিভাগের অনিয়মের প্রতিবাদ হিসেবে ছাঁটাই প্রস্তাব দিয়েছি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বড় কাজ ব্যাংকিং খাতকে সুপারভাইজ করা। কিন্তু জনগণের টাকা লুটপাট হচ্ছে, ব্যাংকে অনিয়ম হচ্ছে। তাহলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বা বাংলাদেশ ব্যাংক কী সুপারভাইজ করছে?’

মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘পিকে হালদার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে চলে গেল বিদেশে। জনতা ব্যাংক থেকে একজন কাস্টমার এক হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে চলে গেল। একটি প্রতিষ্ঠান প্রায় দুই হাজার ২০০ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে নিল। অথচ কৃষকের ৫০ হাজার টাকার জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের লোন মওকুফের চারটি ইনগ্রেডিয়েন্স রয়েছে। চারটার মধ্যে একটাও নেই এমন প্রতিষ্ঠানের কয়েকশ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংকের কয়েকশ কোটি টাকা মওকুফ করে দেওয়া হয়েছে। এ ধরণের কাজগুলো যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে জনগনের টাকা খরচ করে লাভটা কি? তারচেয়ে বরং চুপচাপ থাকাই ভালো। ব্যাংক থেকে যার যা ইচ্ছে মতো নেও, যত পারো লুটপাট করো।’

তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখন ঋণখেলাপি ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে এখন ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি। ঋণ খেলাপিদের ধরতে পারবেন না। পাচার করে বিদেশে চলে যাবে। আজ দেশে ডলারের কেন ক্রাইসিস? ওই সমস্ত ঋণ যারা নেন এবং বড় বড় রাঘব বোয়াল যারা অবৈধভাবে টাকা আয় করেন, তারা ডলার কিনে পাচার করে।’ 

জাতীয় পার্টির এই সদস্য বলেন, ‘ডলার সংকটের বড় কারণ পাচার। আগের অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছুই শুনতে চাইতেন না।’ আর্থিক খাতে অনিয়ম বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা যেই হোক; যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে কানাডা, ইউরোপ আমেরিকায় বাড়ি, হোটেল করেছেন, তদন্ত করে তাদের চিহ্নিত করা হোক। টাকা ফেরাত আনতে না পারলেও তাদের চিহ্নিত করার দাবি জানান তিনি।

স্বতন্ত্র সদস্য পংকজ নাথ বলেন, ‘দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এলসি খোলার ক্ষেত্রে সংযতনীতি পরিহার করে আরও উদার হওয়া দরকার।’ ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আরেক স্বতন্ত্র সদস্য হামিদুল হক খন্দকার বলেন, ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কেন অতিরিক্ত মঞ্জুরি দাবি করেছে, তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। অতীতে আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।’ দেশে লুটপাট করে যারা অর্থ পাচার করেছে, তাদের সে অর্থ ফিরিয়ে আনা হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে অনিয়মের অভিযোগ

আইসিটি বিভাগের লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে চলছে কিনা, তার খবর নেওয়ার দাবি জানিয়ে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘এ প্রকল্পে যারা লার্নিং করতে আসে, তারা সঠিকভাবে আত্মস্থ করতে পারে না। এখানে অপব্যয় হচ্ছে।’ যশোরে শেখ হাসিনা আইসিটি পার্কের অনিয়মের বিষয়ে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন তুলে ধরে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নামে আইসিটি পার্ক করেছেন; সেখানে হোটেল ম্যানেজমেন্ট, বিয়ের অনুষ্ঠান, সামাজিক অনুষ্ঠান কী করে হয়? ব্যবস্থাপনা সরকার না করে তৃতীয় পক্ষকে কেন দেওয়া হয়েছে।’

স্বতন্ত্র এমপি পংকজ নাথ বলেন, ‘আইসিটি খাতে কাজ যে হচ্ছে না, তা নয়। তবে দোয়েলের বাক্স খুললে যদি চায়নিজ কম্পিউটার পাওয়া যায়, তাহলে এটা কি অপচয়, নাকি দুর্নীতি? এর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, তা সংসদ জানতে চায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের নামে যে কম্পিউটার দিয়েছেন, সেগুলোতে কী কাজ হচ্ছে, নাকি জং ধরেছে।’ ডাক বিভাগের জমির অবস্থা কী জানতে চান পংকজ নাথ।

সম্পূরক বাজেট পাস

ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনা শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ‘নির্দিষ্টকরণ (সম্পূরক) বিল-২০২৪’ সংসদে তোলেন। পরে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া অর্থবছরের কার্যক্রম নির্বাহের জন্য সংযুক্ত তহবিল থেকে মঞ্জুরি করা অর্থের বেশি বরাদ্দ ও নির্দিষ্টকরণের কর্তৃত্ব প্রদানে এই সম্পূরক বিল আনা হয়।

চলতি অর্থবছর মূল বাজেটে ৬২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অনুকূলে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। সংশোধিত বাজেটে ২২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বরাদ্দ বেড়েছে ৩৭ হাজার ৮১৭ কোটি টাকার বেশি। ৪০টির বাজেট অপরিবর্তিত রয়েছে বা কমেছে। সার্বিকভাবে ৪৭ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা কমে সংশোধিত বাজেট হয়েছে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকার।

সম্পূরক বাজেটে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৬৪৯ কোটি ৩৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা পেয়েছে পরিকল্পনা বিভাগ। সম্পূরক বাজেটে ২০টি দাবির বিপরীতে ৬৬টি ছাঁটাই প্রস্তাব দেন চারজন সংসদ সদস্য।

আরও পড়ুন

×