ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বিচার পেতে অপেক্ষা বছরের পর বছর

বিচার পেতে অপেক্ষা বছরের পর বছর

কোলাজ

 ওয়াকিল আহমেদ হিরন

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪ | ০১:১৬ | আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪ | ১৩:০৩

চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতির অনেক মামলার বিচার বছরের পর বছর ঝুলে আছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে থাকা এসব মামলার বিচার নানা জটিলতার কারণে শেষ করা যাচ্ছে না। এতে বিচারপ্রার্থী ও আসামিপক্ষের হয়রানি বাড়ছে। 

রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, উচ্চ আদালতে আগের চেয়ে দ্রুত হারে মামলা নিষ্পত্তি হলেও জট কমছে না। এর অন্যতম কারণ, পুরোনো মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা। বেঞ্চ বাড়িয়ে এসব মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেওয়া উচিত। 

গত ২৪ এপ্রিল আপিল বিভাগে তিনজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আপিল বিভাগে বর্তমানে প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতি আটজন। এত দিন বিচারপতি কম থাকায় মামলা নিষ্পত্তির হার তুলনামূলক কম ছিল। বিচারপতি সংকটের কারণে ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ, পিলখানা হত্যা মামলার মতো অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ মামলা শেষ করা যাচ্ছে না। নতুন তিন বিচারপতি নিয়োগের পর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নির্দেশনায় আপিল বিভাগে দুটি বেঞ্চে বিচারকাজ শুরু হয়েছে। নতুন বেঞ্চে প্রধান রয়েছেন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সমকালকে বলেন, আপিল বিভাগে বিচারক বাড়ানোয় দুটি বেঞ্চ গঠনের পর ক্রমানুসারে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনানির জন্য আগামী ১১ জুলাই ধার্য করা হয়েছে। পিলখানা হত্যা মামলার আপিল শুনানির জন্য আলাদা বেঞ্চ দরকার।  

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশ কিছু হত্যা মামলায় আসামিদের বিচারিক আদালতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর হাইকোর্টে এসে দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে। এ ছাড়া দুর্নীতির বেশ কিছু মামলার আপিল শুনানি উচ্চ আদালতে আটকে আছে। এর মধ্যে রয়েছে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা, অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচার, উৎকোচ গ্রহণ, সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতি ইত্যাদি। দুর্নীতির এসব অভিযোগ রাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, এমন মামলা দেড় হাজারের বেশি। হলমার্ক গ্রুপ, ডেসটিনিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির দুর্নীতির মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি জানিয়েছেন আইনজীবীরা। মামলাজটের কারণে চাপা পড়ে আছে আলোচিত এসব আপিল মামলার শুনানি। 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ডেথ রেফারেন্স মামলার পেপারবুক (বিজি প্রেস থেকে) তৈরিতে বিলম্ব, শুনানির সিরিয়াল পেতে বিলম্ব, ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য উভয় পক্ষ প্রস্তুত না থাকা, আইনজীবীদের একাধিকবার সময় আবেদন, হাইকোর্টে ফৌজদারি আপিল ও ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানিতে পর্যাপ্ত বেঞ্চ না থাকা এবং বিচারক সংকটের কারণে মামলার নিষ্পত্তি বিলম্বিত হচ্ছে। ফলে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমছে না। বর্তমানে হাইকোর্টের তিনটি বেঞ্চে ফৌজদারি অপরাধের মামলার আপিল শুনানি হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সের প্রায় সাড়ে ৯০০ মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।      

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী জেড আই খান পান্না সমকালকে বলেন, উচ্চ আদালতে মামলাজট প্রকট। ফৌজদারি অপরাধের মামলা শুনানিতে বিলম্ব হওয়ায় বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তি কমছে না। হাইকোর্ট বিভাগে আরও বিচারক নিয়োগ দিতে হবে এবং বেঞ্চ বাড়াতে হবে। এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। 

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সর্বোচ্চ আদালতে দুই ডজনের বেশি চাঞ্চল্যকর মামলার চূড়ান্ত বিচার দীর্ঘদিন আটকে আছে। এর মধ্যে রয়েছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের রিভিউ, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা, ৪২ যুদ্ধাপরাধীর আপিল মামলা, পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ দাস হত্যা, পিলখানা হত্যা, কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখার মামলা, আওয়ামী লীগ নেতা আহ্সান উল্লাহ্ মাস্টার হত্যা মামলা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা। পাশাপাশি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অবৈধভাবে নেওয়া টাকা ফেরত প্রদানসংক্রান্ত মামলা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে করা মামলা আপিল বিভাগে বিচারাধীন। 

এ ছাড়া হাইকোর্ট বিভাগে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে শেখ হাসিনার জনসভায় পুলিশের গুলিতে ২৪ জনের মৃত্যুর মামলা, ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলা, টেকনাফে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। 
এ প্রসঙ্গে আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান সমকালকে বলেন, প্রধান বিচারপতির নির্দেশনায় চাঞ্চল্যকর মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বেশ কিছু পেপারবুক প্রস্তুত হয়েছে। 

সাবেক একজন প্রধান বিচারপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, মাত্র ৮৪ জন বিচারক দিয়ে লাখ লাখ মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তির জন্য প্রত্যেক প্রধান বিচারপতিকে বিভিন্ন কৌশল ও পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয়। পুরোনো মামলা নিষ্পত্তি এবং বিচার বিভাগের ডিজিটাইজেশনের ওপর আরও জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

আরও পড়ুন

×