পিএসসির প্রশ্ন ফাঁসচক্র
চাকরি দিয়েছেন শতজনকে, কারও সম্পদের পাহাড়
বগুড়ার মামুনুর ও নিয়ামুল চাকরি দিয়েছেন অনেক আত্মীয়কে

প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সদস্য শাহাদত হোসেনের নাটোরের সিংড়ায় গ্রামের বাড়ির বিশাল পুকুর এবং উপশহরের অর্ধকোটি টাকার জমি ও বাড়ি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৪ | ০১:১৫ | আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৪ | ০৯:৩৫
প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের একের পর এক বিত্তবৈভবের তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, এসব অপকর্ম করেই বাড়ি-গাড়ি, প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন তারা। সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীর পক্ষে বৈধভাবে এত সম্পদের মালিক হওয়া সম্ভব নয়। ধারণা করা হচ্ছে, প্রশ্নপত্র বিক্রি আর নিয়োগ বাণিজ্যের টাকা দিয়েই তারা এসব সম্পদ বানিয়েছেন।
বগুড়া ব্যুরো জানায়, গাবতলী উপজেলার বাইগুনি গ্রামের মামুনুর রশিদ ও একই উপজেলার নাড়ুয়ামালা দোয়ারপাড়া এলাকার নিয়ামুল হাসান জেমস গ্রেপ্তার হওয়ার পর এলাকায় তাদের কুকর্মের কথা ছড়িয়ে পড়েছে। দু’জনের পরিবারের সবাই এবং আত্মীয়স্বজন সরকারি চাকরি করেন।
এলাকায় বেশ কয়েকজনকে চাকরি দিয়েছেন অর্থ ও জমির বিনিময়ে। মামুনের ভাই ফারুকুল ইসলামকে চাকরি দেন প্রকৌশল অধিদপ্তরে। তাঁর স্ত্রী চাকরি করেন একই দপ্তরে। চাচাতো ভাই মহিদুল ইসলাম, জিদাহ হাসান ও জিকো চাকরি করেন কৃষি অধিদপ্তরের বিভিন্ন শাখায়। নিয়ামুল হাসানের দুই বোন জেমি বেগম ও জেলি বেগম এবং স্ত্রী মৌসুমী আক্তার, ভগ্নিপতি এবং চাচাতো-ফুফাতো ভাইসহ ১১ জনকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন তিনি।
নিয়ামুল নিজ এলাকার পলাশ হাসান নামে এক যুবককে চাকরি দিয়েছেন এক বিঘা জমির বিনিময়ে।
গাবতলী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল গফুর বিপ্লব জানান, নিয়ামুল ও মামুনুর রশিদ একটি চক্রের সঙ্গে জড়িত থেকে অর্থ ও জমির বিনিময়ে চাকরি দিয়েছেন। এ নিয়ে তিনি আগে সরকারের যথাযথ দপ্তরে অভিযোগও দিয়েছিলেন।
নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, পিএসসির সহকারী পরিচালক আলমগীর কবিরের বাড়ি জেলার বদলগাছীর কোলা ইউনিয়নে গয়রা সরদারপাড়া গ্রামের সাধারণ এক দিনমজুর পরিবারে। নিজেকে অনেক বড় চাকরিজীবীর পাশাপাশি কোচিং ব্যবসায়ী হিসেবে এলাকায় পরিচয় দেন। তিনি নিজ গ্রামের প্রায় একশজনকে সরকারি চাকরি দিয়েছেন। কয়েক বছর আগেও তাঁর বাবা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। ছাত্রজীবনে ছোট ভাই হুমায়ুন কবিরসহ আলমগীর কবির অন্যের জমিতে কাজ করতেন। কিন্তু পিএসসিতে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর চাকরি হওয়ার পর বদলে যেতে থাকে তাদের অবস্থা।
আলমগীরের বাবা আবুল কাসেম বলেন, তাঁর ছেলের ঢাকায় বিলাসবহুল বাড়ি এবং গাড়ি থাকলেও গ্রামের বাড়িতে তেমন কিছুই করেনি। মাঝেমধ্যে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে বাড়ি আসে এবং তাদের পরিবারের খরচ দিয়ে যায়। তিনি বলেন, সম্প্রতি আলমগীর গ্রামের বাড়িতে বিঘা দশেক জমি কিনেছে। এর চেয়ে বেশি কিছু তিনি জানেন না।
কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, কুমিল্লার গোমতী তীরের আদর্শ সদর উপজেলার বানাশুয়া গ্রামের আবদুল ওহাবের ছেলে আবু সোলেমান সোহেল এলাকায় কয়েক কোটি টাকার জমি কিনেছেন। নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন। দুই ভাইয়ে স্বর্ণ ব্যবসায় মূলধন দিয়েছেন। এলাকাবাসীর ভাষ্য, গত ৮-১০ বছরে সোহেল এলাকায় বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কিনেছেন। সর্বশেষ গত রমজানের ঈদের আগে সোহেল বাড়ির পাশে ৬০ শতক জমি দেড় কোটি টাকায় কেনেন। ঢাকায় তাঁর আবাসন ব্যবসা রয়েছে। এ ছাড়া শেয়ার ব্যবসায় লগ্নি করেছেন বিপুল অর্থ।
খুলনা ব্যুরো জানায়, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার পিএসসির অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান খুলনা নগরীর রায়েরমহল এলাকায় পৈতৃক জমিতে এক তলা বাড়ি করেছেন। খলিলের মা রোকসানা বেগম জানান, খলিল ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনেছে। দুই-তিনবার সেই ফ্ল্যাটে গেছেন তিনি। খলিলের বাবা নিজাম উদ্দিন গাজী পিএসসিতে অফিস সহায়ক পদে চাকরি করতেন। পোষ্য কোটায় ২০০৮ সালের দিকে পিএসসিতে অফিস সহায়ক পদে খলিলের চাকরি হয়। পরের বছর পোষ্য কোটায় পিএসসিতে দারোয়ান পদে চাকরি হয় খলিলের বড় ভাই হাবিবুর রহমানেরও।
ফুলবাড়িয়া (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ইচাইল গ্রামের ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি সাহেদ আলীর ছেলে সাখাওয়াত হোসেন ও সাইম হোসেন ঈদ এলে গাড়িতে চড়ে আসতেন। দু’জনের ফিটফাট দেখে গ্রামের মানুষ তাদের সাহেব বলে সম্বোধন করত। পরিচয় দিতেন ঢাকায় ব্যবসা আছে।
সিংড়া (নাটোর) প্রতিনিধি জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্য শাহাদত হোসেন নাটোরের সিংড়া উপজেলার তাজপুর ইউনিয়নের কাদিরগাছা এলাকার বাসিন্দা। শাহাদত তাঁর গ্রামের ভিটায় তিন বিঘা জায়গায় ফলের বাগান ও কাদিরগাছা বিলে পাঁচ বিঘা জমির ওপর পুকুরের মালিক। এ ছাড়া ঢাকার ইব্রাহিমপুরে একটি এবং মিরপুরে আরেকটি ফ্ল্যাটের মালিক। সিংড়া শহরে অর্ধকোটি টাকা মূল্যর ৮ শতক জায়গা এবং সরকারপাড়া এলাকায় ৫ শতক জায়গার মালিক তিনি। শাহাদত প্রথমে কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন বলে জানান তাঁর চাচাতো ভাই হাফিজুর রহমান।
গাইবান্ধা সংবাদদাতা জানান, গাইবান্ধায় জন্ম নেওয়া পিএসসির উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমকে স্থানীয়রা ফুয়াদ নামেই বেশি চেনেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব চন্দিয়া গ্রামে। জাহাঙ্গীরের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর পৈতৃক বাড়িটি জীর্ণশীর্ণ। জাহাঙ্গীরের বাবা-মা নেই। জাহাঙ্গীরের সম্পর্কে চাচা লিয়াকত আলী জানান, বাবার ভাগের সম্পত্তি (ভিটেমাটি) যা ছিল, এক বছর আগে সে দুই-তিন কোটি টাকায় সব বিক্রি করে গেছে। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় তার গ্রেপ্তারের খবর শুনে আমরা ভীষণ লজ্জায় পড়েছি।
- বিষয় :
- অবৈধ সম্পদ
- অবৈধ সম্পদ অর্জন