সাক্ষাৎকার: আখতার হোসেন
নতুন সংবিধান প্রণয়নে হবে গণপরিষদ
ব্যক্তিগতভাবে চাই তারেক রহমান দেশে আসুক, দলের হাল ধরুক

আখতার হোসেন
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৪ | ০১:১৬ | আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২৪ | ১০:৩৪
গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান সংগঠক ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন সমকালকে বলেছেন, গণপরিষদ গঠন করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের চিন্তা রয়েছে। গণহত্যার দায় থাকায় আওয়ামী লীগকে গণপরিষদে রাখা কঠিন। বিএনপি-জামায়াত গণঅভ্যুত্থানে শামিল হলেও গণপরিষদে কারা প্রতিনিধিত্ব করবেন, তা রূপরেখায় ঠিক হবে। সংবিধান প্রণয়নে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের আশঙ্কা নেই।
ব্যক্তিগতভাবে চাই, তারেক রহমান দেশে ফিরুক। শেখ হাসিনা ফিরলেও তাঁকে রাজনীতিতে চাই না। তাঁকে গণহত্যার বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রাজীব আহাম্মদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি যোবায়ের আহমদ আখতার হোসেনের নেতৃত্বে গত অক্টোবরে গঠিত ছাত্রশক্তি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারে উপদেষ্টা হয়েছেন সদস্য সচিব নাহিদ ইসলাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক আসিফ মাহমুদ ভূঁইয়া।
সমকাল: গণঅভ্যুত্থান নাকি বিপ্লব–কোনটি হয়েছে? বিপ্লবের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানে নানা পথ ও মতের মানুষের একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সম্মিলন ঘটে।
আখতার হোসেন: শুরুতে একটি লক্ষ্যই ছিল। গণহত্যার কারণে শেখ হাসিনার পতনই ছিল প্রধান কর্তব্য। একে গণঅভ্যুত্থান হিসেবেই দেখি। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা এসেছে। এ নিয়ে আমাদের দীর্ঘ সময়ের আলোচনা রয়েছে। এভাবে দেখলে টু সাম এক্সটেন্ট বিপ্লবও রয়েছে।
সমকাল: কিছু পরিমাণ বিপ্লব এবং সম্পূর্ণ বিপ্লবে ফারাক রয়েছে। সফল বিপ্লব, পূর্বঘোষিত লক্ষ্য পূরণের বৈধতা দেয়। গণঅভ্যুত্থানের আগে বলেননি কী কী করবেন। যা বলেননি, তা করতে চাইলে বৈধতার প্রশ্ন থাকবে।
আখতার হোসেন: মুক্তিযুদ্ধের পর যারা গণপরিষদে গেলেন...। তারা সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী ছিলেন। তাদের ইশতেহারে ছিল ছয় দফা। স্বাধীন বাংলাদেশ হবে, সেখানে কী হবে, এমন কিছু ছিল না। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী জনপ্রতিনিধিরাই বাংলাদেশের দায়িত্ব পালন করেন। গণপরিষদে এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। অনিবার্যতাকে (doctrine of necessity) সংবিধান থেকে বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপটে ডকট্রিন অব নেসেসিটি আবার এসেছে। যারা রাজপথে নেমেছে, তারা নতুন রাষ্ট্র কাঠামো চায়। এটাই জনগণের দেওয়া বৈধতা। এটা কাগুজে বৈধতার চেয়েও বড়।
সমকাল: আপনাদের চিন্তায় গণপরিষদ আছে?
আখতার হোসেন: যারা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন আর যারা বাইরে রয়েছি, আমরা চাই খুব দ্রুত যেন একটি সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদ আসে। যাতে নতুন সংবিধান পাই। এখন যে সংবিধান, তা জনগণকে ধারণ করে না।
সমকাল: আপনি আইনের ছাত্র। নতুন সংবিধানের অর্থই হলো, ৩০ লাখ শহীদের রক্তে পাওয়া বিদ্যমান সংবিধান বাতিল; যা আবেগের বিষয়। আরেকটি দিক হলো, বিদ্যমান সংবিধান বিলুপ্ত হলে আইনি এবং সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে।
আখতার হোসেন: একাত্তরের ১০ এপ্রিল ঘোষিত দুই পাতার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিয়ে দেশ চলেছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু খুবই সংক্ষিপ্ত একটি অস্থায়ী সংবিধান দিয়েছিলেন। তা নিয়েই তো আমরা এগিয়েছি। অন্তর্বর্তী সরকার এবং গণপরিষদ যেন চলতে পারে, সেজন্য মধ্যবর্তী একটি সংবিধানে জোরারোপ করছি।
সমকাল: বাহাত্তরের গণপরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ছিলেন। আপনাদের পরিকল্পিত গণপরিষদের সদস্য হবেন কারা? কোন এখতিয়ারে তারা আসবেন? তারা কার প্রতিনিধি হবেন?
আখতার হোসেন: গণপরিষদ যে সংবিধান তৈরি করবে, তা গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদন করানো হবে।
সমকাল: গণভোট পরের কথা। আসল প্রশ্ন, গণপরিষদে বসার এখতিয়ার কী হবে?
আখতার হোসেন: বাহাত্তরের সংবিধান গণভোটে অনুমোদন করানো হয়নি। এবার যে সংবিধান হবে, তা গণভোটে অনুমোদিত হবে।
সমকাল: গণপরিষদের সদস্যরা কীভাবে নির্বাচিত বা মনোনীত হবেন–এই মীমাংসা প্রয়োজন।
আখতার হোসেন: গণপরিষদে জনগণের বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধি থাকবেন। আওয়ামী লীগকে নিয়ে কথা আছে। তারা গণহত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছে। গণহত্যার দায় নিয়ে এই নামে রাজনীতি করার বিষয়ে জনগণের প্রশ্ন রয়েছে। এর বাইরে বাকি যত পক্ষ রয়েছে, তাদের মধ্য থেকে গণপরিষদ হতে পারে। তবে এখনও ঠিক হয়নি, গণপরিষদে সদস্যরা কীভাবে আসবেন।
সমকাল: বিএনপি-জামায়াত গণঅভ্যুত্থানে সর্বাত্মকভাবেই ছিল। ত্যাগও স্বীকার করেছে। আপনাদের পরিকল্পিত গণপরিষদে বিএনপি, জামায়াতের জায়গা হবে?
আখতার হোসেন: বিএনপি হোক বা অন্য কোনো দল, তারা নিজেদের মতো শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।
সমকাল: শুধু ছাত্রদলেরই ২০ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। জামায়াত ও শিবিরের নিহতের সংখ্যা ৫০-এর বেশি। তারা আপনার সঙ্গে জেলে রিমান্ডে ছিলেন।
আখতার হোসেন: অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে বিএনপি ও জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব ছিল।
সমকাল: শপথ অনুষ্ঠানে বসে হাততালি আর সরকারে অংশীদারিত্ব নিশ্চয় এক নয়। গ্যালারিতে থেকে খেলা দেখা, আর খেলায় অংশগ্রহণ এক নয়। বিএনপি-জামায়াত কি গ্যালারিতে থাকবে?
আখতার হোসেন: ব্যক্তিগতভাবে চাই, সংবিধান প্রণয়নের মতো বিরাট বিষয়ে যত পক্ষ আছে, সবার বক্তব্য দেওয়ার মতো প্রক্রিয়া যেন থাকে।
সমকাল: আপনি কিন্তু পরিষ্কার করছেন না, বিএনপি-জামায়াত কি শুধু বক্তব্যই জানাবে? নাকি গণপরিষদেও বসবে?
আখতার হোসেন: এটা কঠিন প্রশ্ন, তারা গণপরিষদে বসবে কিনা। কিন্তু গণপরিষদ এখনও আমাদের ভাবনার মধ্যেই রয়েছে। রূপরেখা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কথা হয়নি।
সমকাল: আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতের কমপক্ষে ৯০ শতাংশ জনসমর্থন রয়েছে। তাদের বাদ দিলে গণপরিষদ বৈধতা পাবে?
আখতার হোসেন: কাউকে বাদ দেওয়ার কথা বলছি না। তাদের কীভাবে যুক্ত করা যায়, সেই রূপরেখা হাজির করব। যারা দীর্ঘ সময় জনপ্রতিনিধিত্ব করেছে, তাদেরসহ অন্যদেরও কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তা রূপরেখায় থাকবে।
সমকাল: গণপরিষদে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হবে?
আখতার হোসেন: সেনাবাহিনী দেশ রক্ষা করবে। সংবিধান প্রণয়নে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের আশঙ্কা নেই।
সমকাল: ৫ আগস্টের সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার যে মধুচন্দ্রিমা পার করছে, তা শেষে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে।
আখতার হোসেন: মধুচন্দ্রিমা নয়, উদযাপনের সময় চলছে। যারা গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের ওপরে অনেক দায়িত্ব এসেছে। সমন্বয়কদের সঙ্গে বসেছি, উপদেষ্টা পরিষদেও কথা পৌঁছে দিয়েছি।
সমকাল: উদযাপনের রেশ ধরেই বলি, বাহাত্তরে বঙ্গবন্ধু খবর পেলেন টাঙ্গাইলের বিখ্যাত এক মুক্তিযোদ্ধা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর জমিদার বাড়ি দখল করেছেন। আপনারা দখলবাজি করবেন না, নিশ্চয়তা দিতে পারেন?
আখতার হোসেন: যা কিছু জনগণের কাছ থেকে বেদখল হয়ে গেছে, তা ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার রাখি। আমাদের কেউ কিছু দখল করবে–এমন হতে পারে না। এ নিশ্চয়তা দিতে চাই।
সমকাল: যত সমালোচনা থাকুক, শেখ হাসিনা সরকার অবকাঠামো উন্নয়ন করেছে। তবে সরকারের ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৮ লাখ কোটি টাকা। শেখ হাসিনা যেসব প্রকল্প চালু করেছেন, তা তো এ সরকার বন্ধ করতে পারবে না। ঋণও শোধ করতে হবে। কিন্তু কীভাবে?
আখতার হোসেন: এখন আমাদের অগ্রাধিকার পুলিশকে কাজে ফিরিয়ে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা। এরপর অবকাঠামো উন্নয়ন শুরু হয়ে যাবে। ঋণের বিষয়ে কাজ করতে হবে। যারা লুটপাট করে টাকা পাচার করেছে, তা ফিরিয়ে আনতে চাই। ঋণ এবং পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ প্রায় সমান।
সমকাল: পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনা সহজ নয়।
আখতার হোসেন: পরিকল্পনা আছে। কিন্তু কতটা ফিরিয়ে আনতে পারব, তা আন্তর্জাতিক বিষয়। ড. ইউনূস এবং সালেহউদ্দিন আহমেদ অর্থনীতির বিষয়ে পণ্ডিত মানুষ।
সমকাল: সংস্কারের কথা বললেও, বিদ্যমান প্রশাসন, পুলিশ দিয়েই দেশ চালাতে হবে। কীভাবে চিহ্নিত করবেন, কোন কোন কর্মকর্তা আগের সরকারে অপকর্ম করেছেন? কারণ পদোন্নতি পেতে সবাই আওয়ামী লীগ সেজেছিলেন।
আখতার হোসেন: সবাইকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র চলবে না। যারা সামনের সারিতে থেকে কিন্তু ফ্যাসিবাদের পক্ষে ছিলেন, দালালি করেছেন, অবশ্যই তাদের বাদ দিতে হবে। যারা পেছনে ছিলেন, তারা যদি নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, তাহলে সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে এগোতে হবে।
সমকাল: আপনারা গণপরিষদ গঠন, নতুন সংবিধান এবং সংস্কারের কথা বলছেন, তা করতে অনেক বছর লাগবে। আপনারা কত সময় সরকারে থাকবেন বলে পরিকল্পনা করছেন!
আখতার হোসেন: কতদিন সময় লাগবে, তা নিশ্চিত নয়। চাইছি, যত স্বল্প সময়ে করা যায়।
সমকাল: এই স্বল্প সময় আসলে কতদিন?
আখতার হোসেন: এটি বলা মুশকিল। তবে প্রয়োজনের বেশি সময় নেওয়ার ইচ্ছা নেই।
সমকাল: বিএনপি-জামায়াত ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন প্রত্যাশা করছে। আওয়ামী লীগও নির্বাচন চায়। এই তিন শক্তির প্রত্যাশা অস্বীকার করবেন?
আখতার হোসেন: বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের আসলেই সত্তাগত সমর্থন আছে। জনগণের বৃহৎ অংশ কিন্তু নতুন কিছু চায়। এই তিন দল যদি গণপরিষদে থাকে, তাহলে তারাও তো প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে যাবে।
সমকাল: আপনারা বিএনপির প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকার, নির্দলীয় সরকার মানেননি। তারেক রহমানের দেশে ফেরারও খবর নেই। তাঁকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে? এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ চাই।
আখতার হোসেন: এটা তো অনেক বড় জায়গা। ব্যক্তিভাবে আমি চাই তারেক রহমান দেশে ফিরুক। তাঁর দলের হাল ধরুক।
- বিষয় :
- সাক্ষাৎকার
- গণপরিষদ
- ডাকসু