শাহীনের কথাই ছিল শেষ কথা

কোলাজ
অমিতোষ পাল ও বকুল আহমেদ
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০১:২৬ | আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১০:১০
বাবা নূর মোহাম্মদ একসময় সাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন রোগের ওষুধ দিতেন। বিনিময়ে নিতেন ধান-চাল, মুরগি-লাউ। সেই ‘নূর কম্পাউন্ডারের’ ছেলে শাহীন আহমেদ গত ১৫ বছর ছিলেন রাজধানীলাগোয়া কেরানীগঞ্জের ‘নিয়ন্ত্রক’। তাঁর অনুমতি ছাড়া ১ শতাংশ জমিও রেজিস্ট্রি হতো না। এলাকায় রয়েছে তাঁর নিজস্ব বাহিনী। অভিযোগ রয়েছে, আলোচিত ‘আব্বা বাহিনী’র প্রধান পৃষ্ঠপোষক এই শাহীন আহমেদ। কেরানীগঞ্জ উপজেলার সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান তিনি।
পদ্মা সেতু ও বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরু হলে অনেক ব্যবসায়ী কেরানীগঞ্জে আবাসন প্রকল্প হাতে নেন। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীন আহমেদকে চাঁদা হিসেবে দিতে হয় প্লট অথবা কোম্পানির শেয়ার। জমিতে বালু ভরাটের কাজও দিতে হয় তাঁকে। স্থানীয়রা জানান, শাহীনের অনুমতি ছাড়া কেরানীগঞ্জে জমি বেচাকেনা করা কঠিন ছিল। বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরীর সব ঘাট ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে। এভাবে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন শাহীন। তিনটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, ৯টি প্লট ও বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে তাঁর প্রায় হাজার শতাংশ জমি। ‘স্বশিক্ষিত’ শাহীন বানিয়েছেন নিজের প্রাসাদোপম বাড়ি।
যেভাবে উত্থান শাহীনের
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সঙ্গে যুক্ত বড় ভাই ফারুক আহমেদের তত্ত্বাবধানে একসময় কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুর ঘাটে ট্রলার থেকে চাঁদা তুলতেন শাহীন। কিছুদিন ঢাকা-মাওয়া রুটে বাসের কন্ডাক্টরিও করেন। ২০০১ সালে ঢাকা-মাওয়া সড়কের পাশে একটি আবাসন প্রকল্পে জলাভূমি ভরাটের কাজ পান। ওই সময় তিনি জমি দখল ও জোর করে অন্যের জমি লিখে নেওয়া শুরু করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, শাহীন ওই সময় অনেককে কম দামে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করেন। পাশাপাশি যুক্ত হন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। এভাবে দিনে দিনে কেরানীগঞ্জে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। ২০০৯ সালে কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন। তখন থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত পদটি ছিল তাঁর দখলে।
বিসিক শিল্পনগরীর পাশে শিল্প পার্ক করার কথা বলে কম দামে স্থানীয়দের জমি কিনে চড়া দামে বিক্রি করেন শাহীন। দক্ষিণ চুনকুটিয়ায় হিন্দুদের জমি দখলেরও অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। এই কাজে শাহীন তাঁর নিজস্ব বাহিনী ব্যবহার করেন। শুভাঢ্যা ইউনিয়নে দখল, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসায় তিনি কাজে লাগান ‘আব্বা বাহিনী’কে।
শাহীনের বাহিনীতে কারা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শাহীন আহমেদের বাহিনীতে ছিলেন তাঁর ভাই শিপু আহমেদ, মামাতো ভাই ও ছাত্রদল থেকে কেরানীগঞ্জ ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়া ইমাম হাসান, ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. ইয়ামি, রুহিতপুরের নাজিম মেম্বার, বশির মেম্বার ও সেলিম হাজী, স্বেচ্ছাসেবক লীগের হারুন মাস্টার, তারাব ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন, কেরানীগঞ্জ ছাত্রলীগের সেক্রেটারি মাসুদ রানা, রুহিতপুর স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মাসুম, জিঞ্জিরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সাকুর হোসেন, শুভাঢ্যা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন এবং হযরতপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আয়নাল হোসেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তারা সবাই রয়েছেন আত্মগোপনে।
সাধারণ মানুষের কান্না
কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দার কৃষক নূর আলীর বিসিক শিল্পনগরীর পাশে ছিল ১৮২ শতাংশ আবাদি জমি। বছর দশেক আগে সেই জমিতে হঠাৎ বালু ফেলা শুরু করেন শাহীনের লোক সেলিম হাজী। অনেক চেষ্টা করেও সেই জমি উদ্ধার করতে পারেননি নূর আলী। জমির দামও পাননি।
নূর আলীর মতো অনেক কৃষকের অন্তত একশ একর জমি শিল্প পার্কের নামে দখল করে বালু ভরাট করা হয়েছে সোনাকান্দা মৌজায়। কাউকে কাউকে নামমাত্র টাকা দিয়ে জমি লিখে নেওয়া হয়েছে। যারা জমির প্রকৃত দাম দাবি করেন, তারা জমি ফেরত বা টাকা কোনোটাই পাননি। ভুক্তভোগীরা বলেন, ‘প্রতিবাদ করলে বিপদ বাড়ে।’
ভুক্তভোগী নূর আলী জানান, বছর চারেক আগে তিনি একই মৌজার ফজলুল হকের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ কৃষিজমি কেনেন। সেই জমি এখনও রেজিস্ট্রি করতে পারেননি। সোনাকান্দায় ১০৪ শতাংশ চাষের জমি রয়েছে মো. বাবুলের। চার বছর আগে ওই জমিতে বালু ফেলেন শাহীন আহমেদের লোক সেলিম হাজী। জমির চারদিকে দেওয়া তিন ফুট উঁচু প্রাচীর তারা ভেঙে ফেলেন। এরপর জমিটি বিক্রি করার জন্য বাবুলকে চাপ দেওয়া হয়। সমকালকে বাবুল বলেন, ‘আমার জমি এখন তাদের প্রজেক্টের মাঝখানে। বিক্রি বা ব্যবহার– কোনোটাই করতে পারছি না।’ স্থানীয়রা জানান, শিল্প পার্কের নামে দখল করা জমি প্লট আকারে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা শতাংশ দরে বিক্রি করেন শাহীন। অথচ সেই জমি তিনি কেনেন প্রতি শতাংশ ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা দরে।
সোনাকান্দা মৌজার জমি রেজিস্ট্রি বন্ধ থাকায় ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আন্দোলনে নামে এলাকাবাসী। তারা ভুক্তভোগীদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বিভিন্ন দপ্তরে পাঠান। এতে বলা হয়, তাদের বেচাকেনা করা জমি রেজিস্ট্রি করছে না কেরানীগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রি অফিস। সোনাকান্দা ছাড়াও উপজেলার কয়েকটি মৌজার জমি রেজিস্ট্রি তখন বন্ধ ছিল। অলিখিত এই নির্দেশনার নেপথ্যে ছিলেন তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ।
এ ছাড়া তেঘরিয়া, বেয়ারা, পশ্চিমদী, পূর্বদী ও বাস্তা মৌজার নির্দিষ্ট কিছু আরএস দাগের জমি রেজিস্ট্রি ও খারিজ বন্ধ ছিল। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে ওই সব মৌজা ও দাগের জমির তালিকা দেয়ালে ঝুলতে দেখা যায়। একাধিক দলিল লেখক জানান, তালিকায় থাকা মৌজা ও দাগের জমি কেনাবেচা করতে হলে শাহীনের অনুমতি লাগত। সে ক্ষেত্রে দলিল খরচ লাগত বেশি।
সম্পদ বেড়েছে জ্যামিতিক হারে
শাহীন আহমেদ এখন বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) দেওয়া হলফনামায় তিনি নিজেকে ‘স্বশিক্ষিত’ উল্লেখ করেন। ২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচনের সময় তাঁর কাছে নগদ ছিল সাড়ে ৩৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া কিউট হোমসে ছিল ১০ লাখ টাকার শেয়ার, অকৃষিজমি ৮৯ শতাংশ এবং স্বর্ণালংকার ২৯ ভরি। ট্রেডিং ব্যবসায় বিনিয়োগ ছিল ১৭ লাখ টাকা। স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের আয় ছিল না।
তবে ২০২৪ সালে উপজেলা নির্বাচনের সময় দেওয়া হলফনামায় তাঁর বিপুল অর্থ-সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, ৯টি প্লটের মালিক হয়েছেন তিনি। এসব প্লটে জমি প্রায় ৯০ শতাংশ। এর বাইরে স্ত্রীর নামে রয়েছে ২৩৬ শতাংশ এবং আর স্বামী-স্ত্রী উভয়ের নামে আরও ১৩০ শতাংশ জমি। তাঁর হাতে নগদ রয়েছে ৩৭ লাখ ও স্ত্রীর ৪ লাখ টাকা। ব্যাংকে স্ত্রীর নামে আছে পাঁচ লাখ ও নিজের এক লাখ টাকা। ‘মিডিয়া টুডে’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন তিনি। নিজের বছরে আয় ৩৪ লাখ ও স্ত্রীর ৬১ লাখ টাকা। কাকরাইলে রয়েছে ১৪০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট। ‘তাসফিয়া ডেইরি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন তাঁর স্ত্রী। ট্রেডিং ব্যবসায় নিজের বিনিয়োগ বেড়ে হয়েছে প্রায় তিন কোটি ও স্ত্রীর প্রায় সোয়া কোটি টাকা। স্থানীয়রা বলেন, হলফনামার বাইরেও শাহীন আহমেদের সম্পদ ও ব্যবসা রয়েছে দেশে-বিদেশে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে শাহীন আহমেদ আত্মগোপনে। কেউ বলছেন, তিনি দেশ ছেড়েছেন, কেউ বলছেন দেশেই আছেন। তবে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে এলাকায় গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
- বিষয় :
- সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড