মেয়র-কাউন্সিলর বরখাস্তে নাগরিক সেবা শিকেয়

কোলাজ
অমিতোষ পাল ও লতিফুল ইসলাম
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:২২
দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়রকে বরখাস্তের পর কাউন্সিলরদেরও বরখাস্ত করা হয়েছে। এতে নাগরিক সেবা উঠেছে শিকেয়। নাগরিকত্বের সনদসহ নানা প্রয়োজনে লোকজন কাউন্সিলর কার্যালয়ে এসে ফিরে যাচ্ছেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গা-ঢাকা দেন মেয়র ও কাউন্সিলররা। সেই থেকে নগরবাসীর ভোগান্তি শুরু। এর পর গত ১৯ আগস্ট সব সিটির মেয়রকে বরখাস্ত করে প্রশাসক নিয়োগ দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। গত ২৬ সেপ্টেম্বর একযোগে সব সিটি করপোরেশন ও ৩২৩টি পৌরসভার কাউন্সিলরকে বরখাস্ত করা হয়। এর পর থেকে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় নাগরিক সেবা নেই। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনসহ দেশের সব সিটি করপোরেশনের সেবা কার্যক্রম। অথচ ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই এই রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
এদিকে, সব কাউন্সিলরকে একসঙ্গে বরখাস্ত করায় আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য দল থেকে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ। তারা বলছেন, ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকায় তারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। অথচ বিনা অপরাধে তাদের বরখাস্ত করা হলো।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংরক্ষিত ১২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর বিএনপি নেত্রী সুরাইয়া বেগম বলেন, ‘প্রতিদিন এলাকাবাসী নানা প্রয়োজনে বাসায় ভিড় করছে। কারও প্রত্যয়নপত্র দরকার, কারও নাগরিক সনদ দরকার। কিন্তু এগুলো দেওয়ার এখতিয়ার এখন নেই।’
একই কথা বলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বিএনপির আরেক কাউন্সিলর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘এখন ডেঙ্গুর মৌসুম। অন্য বছর প্রতিদিন এলাকায় ঘুরে নাগরিকদের সচেতন করেছি। তাতে কিছুটা হলেও কাজ হতো। কিন্তু এখন সেটি করার কোনো লোক নেই। এ অবস্থায় ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।’ আওয়ামী লীগের বাইরে ডিএসসিসিতে বিএনপি-জাতীয় পার্টির ১২ জন এবং ডিএনসিসিতে দু’জন কাউন্সিলর ছিলেন। তাদের কেন বাদ দেওয়া হলো– সেই প্রশ্ন রাখেন তিনি।
গতকাল রোববার স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে কাউন্সিলরদের কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় কমিটি গঠনের আদেশ জারি হয়। এতে প্রশাসককে প্রধান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। রাজধানীর দুই সিটির দুই কমিটিতে সদস্য রাখা হয়েছে ২৫ জন করে। কমিটিতে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, রাজউক, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রতিনিধি রয়েছেন। এসব প্রতিনিধি কাউন্সিলর হিসেবে সেবা প্রদান করবেন। একইভাবে অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় সংখ্যাভেদে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু এ ধরনের কমিটি নাগরিকদের কতটুকু সেবা দিতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনপ্রতিনিধিরা যেভাবে সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন বা এলাকার সমস্যার কথা জানেন, এমনকি তারা গভীর রাতেও অনেক সময় মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান, সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষে সেভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না। এ ছাড়া রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের সাধারণ ও সংরক্ষিত মিলিয়ে কাউন্সিলর ছিলেন ১৭২ জন। সেখানে দুই কমিটির ৫০ জনের পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া যেসব কর্মকর্তাকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাদের নিজের দপ্তরের কাজ থাকবে। নিজের কাজ সামলিয়ে কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন তাদের জন্য কঠিন হবে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার নাগরিকরা এতে সেবাপ্রাপ্তির সংকটে ভুগবেন।
এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিরা যাই হোক, তাদের লাগবে। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে এখন জনপ্রতিনিধি নেই। তবে এই অবস্থা বেশি দিন দীর্ঘায়িত করা ঠিক হবে না। এতে নাগরিক সেবা বিঘ্নিত হবে। এ জন্য যেসব সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলো দ্রুত করে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।’
সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে মানুষ
গতকাল সকালে ডিএসসিসির ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ফাঁকা অফিসে একজন অফিস সহকারী বসে আছেন। সেখানে কথা হয় ওয়ারিশ সার্টিফিকেট নিতে আসা শাহিন সুলতানার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সকাল ৯টায় এসেছি, অফিসে কেউ নেই। কাগজ নিয়ে বসে আছি।’
সেগুনবাগিচায় কাঁচাবাজার মার্কেটের তৃতীয় তলায় ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকেও সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে মানুষ। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মার্কেটের নিচে দেখা হয় মাঝবয়সী চান শেখের সঙ্গে। প্রত্যয়নপত্র নিতে এসেছেন তিনি। তবে কাউন্সিলর কার্যালয়ে ঢুকতে পারেননি। কারণ নিচতলার সিঁড়ির কেচিগেটে তালা ঝুলছে। মার্কেটের এক দোকানি জানান, গত ৫ আগস্ট থেকে এই গেটে তালা ঝুলছে। একই অবস্থা ঢাকা উত্তর সিটির ওয়ার্ডগুলোতে।
এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘পরিবর্তিত অবস্থায় নগরসেবা চালু রাখতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় কাজ চলছে। কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতিতে বিশেষ কোনো অসুবিধা হবে না।’
- বিষয় :
- নাগরিক সেবা কেন্দ্র