ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

মানব পাচার মামলা: আট বছরে নিস্পত্তি মাত্র ২৩৩টি

মানব পাচার মামলা: আট বছরে নিস্পত্তি মাত্র ২৩৩টি

প্রতীকী ছবি

ওয়াকিল আহমেদ হিরন

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২০ | ০৮:২৬

মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে গত আট বছরে ৬ হাজার ১৩৪টি মামলা দায়ের হলেও নিস্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৩৩টি। দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ৫ হাজার ৯০১টি মামলা। আদালতে সময়মতো আসামি ও সাক্ষী হাজির করতে না পারায় অগনিত মামলা শুনানি করা যাচ্ছে না। ফলে বিচারিক আদালতে মামলার কার্যক্রম ঝুলে আছে।

জানা গেছে, দেশে মানব পাচারের বড় এলাকা কক্সবাজার। সেখানে এ পর্যন্ত মানব পাচারের ৬৪২টি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত একটিও বিচার শেষ হয়নি।

এ ছাড়া গত কয়েক বছরে মানব পাচার অভিযোগের আট হাজার আসামি থাকলেও দুর্বল তদন্ত ও আদালতে সাক্ষী হাজির করতে না পারায় অধিকাংশ অপরাধীদের শাস্তি হয়নি। আইনে জামিন অযোগ্য হলেও উচ্চ আদালত থেকে অধিকাংশই জামিন পেয়ে যাচ্ছে। ফলে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িতরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

গত ২৮ মে লিবিয়ার মিজদা শহরের মরুভুমিতে ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মারাত্মক আহত হন আরও ১১ জন। এ ঘটনায় গত ২ জুন হাজি কামাল হোসেন নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তাদের দাবি হাজী কামাল মানবপাচারের মূলহোতা। রাজধানীর তেজগাঁও ও পল্টন থানায় করা পৃথক মামলায় অভিযান চালিয়ে ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। শুধু এ ঘটনায় নয়, বিদেশে ভাগ্য বদলাতে গিয়ে পাচারকারীদের হাতে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছেন অগনিত মানুষ। পাচারকারিদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। এসব ঘটনায় বিচার চেয়ে নিহতের পরিবার বিভিন্ন সময় মামলা করলেও সুবিচার পাচ্ছেন না। অবিলম্বে পাচারকারিদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তুমুলক শাস্তি দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ঠরা।

এদিকে, মানবপাচার প্রতিরোধ দমন আইনে বিচারের জন্য আলাদা করে বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান থাকলেও ৮ বছর পর চলতি বছর ৯ মার্চ সাত বিভাগে সাতটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের আদেশ হয়েছে। একই সঙ্গে বিচারকও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে, করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবের কারণে আদালত বন্ধ থাকায় নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকরা এখনও  আলাদা ট্রাই্যুনালে কাজ শুরু করতে পারেননি। জানাগেছে, নারী ও শিশু আদালতে থাকা বিচারাধীন মামলাগুলো মানবপাচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। ফলে এসব মামলার বিচার এখনো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেই চলছে।

ঢাকা মহানগর পিপি আবদুল্লাহ আবু সমকালকে বলেন, মানবপাচার গর্হিত অপরাধ। এসব মামলা আদালতে খুব সিরিয়াসভাবে পরিচালনা করা উচিত। তিনি বলেন, সাক্ষীরক কারণে এসব মামলার বিচার ধীরগতিতে হয়। অল্পসময়ে এসব মামলার চার্জশিট দেওয়া উচিত। দ্রুত তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করা উচিত। কিন্তু পুলিশ তো সেটা করেনা।

তিনি বলেন, মানবপাচার মামলা বিচারের জন্য আলাদা ট্রাই্যুনাল গঠনের আদেশ হয়েছে কিন্তু এখনো সেটা কার্যকর হয়নি। নারী শিশু আদালতেই মানপাচার মামলার বিচার চলছে। বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানব পাচার আইন অনুযায়ী তিন মাসের মধ্যে অভিযোগ গঠন আর ছয় মাসেই বিচার কার্যক্রম শেষ করার কথা। কিন্তু মামলায় সাক্ষী নিয়মিত পাওয়া যায় না। পুলিশ সাক্ষীদের ঠিকমতো হাজির করতে পারে না। ফলে মামলা বিচার শেষ করতে দেরি হচ্ছে।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সমকালকে বলেন, মানবপাচার মামলা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন। যারা মানবপাচার করছে তাদের বিচার আদালতকে সঠিক আইনে সম্পন্ন করতে হবে। যেন কোন অপরাধি আইনের ফাক-ফোকরদিয়ে পার পেয়ে না যায়। এ ব্যপারে আদালত, প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থাকে সতর্ক থাকতে হবে। এটি করা গেলে নিশ্চই মানবপাচার কমে আসবে।

আদালত সুত্রে জানা গেছে, রাজধানীর  ক্যান্টনমেন্ট থানার ২০০২ সালের একটি মামলায় এবং তেজগাঁও থানায় ২০০৫ সালের একটি মামলায় কমপক্ষে অর্ধশত বার হাজিরের তারিখ পড়লেও পুলিশ সাক্ষী হাজির করতে না পারায় মামলা নিস্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগছে। ফলে বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে মানব পাচারের মামলা। এতে ভুক্তভোগীরা হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।  মানব পাচার-সংক্রান্ত মামলাগুলো গতানুগতিকভাবেই তদন্ত করা এবং মামলার বাদি ও সাক্ষী দুর্বল থাকায় পাচারের শিকার মানুষ বিচার পায় না। এক পর্যায়ে প্রভাবশালী আসামিরা খালাস পেয়ে যায়।  যে কারণে ভুক্তভোগীরা সুবিচার না পেয়ে হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম সমকালকে বলেন, মানব পাচার মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এই অপরাধের বিচার না হলে অপরাধীরা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, লিবিয়ার ঘটনার পর আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি। এ ব্যাপারে প্রযোজনীয় পদক্ষেপ নিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মুল পাচারকারিদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দেওয়া হলে অপরাধ কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

আইনজ্ঞরা বলেন, এ আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি হলে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও পুলিশকে আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে বলেও মত দেন তারা।

২০১২ সালের ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে’ সংঘবদ্ধভাবে মানবপাচারের জন্য মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সর্বনিম্ন সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অন্যূন পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান আছে।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্য বলছে, আইনটি হওয়ার পর গত আট বছরে দেশে ছয় হাজার ১৩৪টি মামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন আদালতে ২৩৩টি  মামলা নিস্পত্তি হয়েছে। বিচারাধীন রয়েছে ৫ হাজার ৯০১টি মামলা। এরমধ্যে ৩৩টি মামলায় ৫৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে।

আরও পড়ুন

×