প্রাণিসম্পদের বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে হোঁচট

.
জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৪ | ০১:৪২ | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৪ | ২১:১২
সম্ভাবনাময় প্রাণিসম্পদ খাতকে এগিয়ে নিতে দেশে প্রথমবারের মতো সবচেয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বার বার হোঁচট খাচ্ছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প বাসন্তবায়ন না হওয়ায় সময়সীমা ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাড়িয়েও নতুন করে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) বিভিন্ন খাতে ১ হাজার ২৫৩ কোটি টাকার কার্যক্রম বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে। এমন সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেছেন প্রাণিসম্পদ খাতের সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি থাকলে তা বন্ধ করতে হবে। এই মুহূর্তে প্রকল্পের কার্যক্রম বাতিল করলে এই খাত মুখ থুবড়ে পড়বে। প্রকল্পের অনেক কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। নতুন যেসব কাজ করার কথা ছিল তার সঙ্গে পুরনো কাজের সম্পর্ক আছে। প্রান্তিক খামারি কিংবা বিশেষজ্ঞদের মতামত না নিয়ে এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় দ্য লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট-এলডিডিপি বা ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বিশ্বব্যাংকের তিন হাজার ৮৮৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকার সহায়তাসহ প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় চার হাজার ২৮০ কোটি ৩৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। দেশের তিন পার্বত্য জেলা বাদ দিয়ে ৬১টি জেলার ৪৬৫টি উপজেলায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০১৯ সালে নেওয়া প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল চার হাজার ২৮০ কোটি ৩৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। বর্তমান ডলার মূল্যে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৩৮৯ কোটি ৯২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৭৬ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।
প্রকল্পের অধীনে সারাদেশে সাড়ে ৬ হাজার প্রডিউসার গ্রুপ বা পিজি (উৎপাদক দল) গঠন করা হয়েছে। এই গ্রুপের ২ লাখ ৪২ হাজার খামারি প্রকল্পের সুফল পাচ্ছেন। প্রায় সাত হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও লাইভস্টক সার্ভিস প্রভাইডারকে (এলএসপি) বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে ৩০ থেকে ৪০ জন খামারি বা পশু পাখি পালনকারীদের নিয়ে সমিতি গঠন করা হয়েছে।
এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় প্রাণিসম্পদ সেবা বা পশুর চিকিৎসা সুবিধা উপজেলার প্রান্তিক পর্যায়ের খামার বা কৃষকের বাড়িতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৬০টি গাড়ি কিনে ভ্রাম্যমাণ ভেটেরিনারি ক্লিনিক করা হয়েছে। এসব গাড়ি জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে মনিটর করা হয়। বিশেষ করে পশুসম্পদ খাতকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যই সরকার স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এককভাবে প্রাণিসম্পদের জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এত কিছু পর প্রকল্পটির কার্যক্রম বাতিল করলে ৪ হাজার ২০০ ইউনিয়ন কর্মী, ৯৪৮ জন মাঠকর্মী, ৪৮৮ কর্মকর্তা এবং ৪৭৫ জন গাড়ি চালক বেকা হয়ে যাবেন। এ ছাড়া লাখ লাখ খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পের শুরুতে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে দেরি হয়েছে। এ ছাড়া করোনা মহামারির কারণে দুই বছর প্রকল্পের কার্যক্রম ধাক্কা খেয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে প্রকল্পের সেবা যখন খামারির দোরগোড়ায় যাচ্ছিল তখনই টাকা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের যতগুলো প্রকল্প রয়েছে, তার মধ্যে এলডিডিপি বেশ ভালো পর্যায়ে রয়েছে। এটি দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসছে। প্রকল্পের প্রতিটি কার্যক্রমে একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ক। ফলে শেষ সময়ে এসে ১২৫৩ কোটি টাকার কার্যক্রম বাতিল করলে প্রকল্পটি একেবারেই মুখ থুপড়ে পড়বে। এতে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে প্রান্তিক খামারি। যেমন খামারিদের জন্য নির্ধারিত কিছু হাইজিনিক ক্লিনিং টুলস ইতোমধ্যে কেনার জন্য এলসি খোলা হয়েছে, বাকিগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে খামারি গ্রুপের অনেক সদস্য এসব উপকরণ থেকে বঞ্চিত হবেন।
জানা গেছে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর উপদেষ্টা ফরিদা আখতার প্রকল্পটির ওপর নজর রাখছিলেন। সম্প্রতি এক বৈঠকে প্রকল্পটির এক হাজার ৭৩ কোটি ৫৪ লাখ ৭২ হাজার টাকার কার্যক্রম বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়। বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে সভা করে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার সুপারিশ করা হয়।
প্রকল্পের যেসব কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ ভবন (সাততলা) ১৫ কোটি টাকা, সাভারে ডেইরি উন্নয়ন বোর্ডের ভবন (সাততলা) ২০ কোটি টাকা, তিনটি মেট্রো স্লটার হাউস (রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রাম) ২৯৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, তিনটি জেলা কসাইখানা ২৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা, পাঁচটি কাঁচাবাজার (ওয়েট মার্কেট) ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ডেইরি হাব স্থাপন (পাঁচটি) ১০ কোটি পাঁচ লাখ টাকা, স্মল স্কেল ফিড মিলার (১১০টি) দুই কোটি সাত লাখ ৫০ হাজার টাকা।
কুমিল্লার খামারী তোফাজ্জল হোসেন বলেন, সারাদেশে খামারিদের সংগঠিত করে দুধ ও দুগ্ধজাতীয় পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, মান নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড আইন। আইনের আওতায় 'ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড' গঠন করা হয়। এ জন্য সাভারে বোর্ডের একটি ভবন করার জন্য জায়গাও নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ভবন নির্মাণের কাজ বাতিল করলে খামারিদের দীর্ঘ দিনের স্বপ্নের ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড হুমকিতে পড়বে। তিনি বলেন, প্রডিউসার গ্রুপ বা পিজি হচ্ছে প্রাণিসম্পদ ও পণ্য উৎপাদনে সম্পৃক্ত কোনো অঞ্চলের ক্ষুদ্র খামারীদের একটি সংগঠন। ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড ব্যতিত প্রডিউসার গ্রুপগুলো টিকবে না।
নোয়াখালীর খামারী মাহমুদুল হাসান বলেন, কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের পর এখন বাকি বরাদ্দের টাকা ফেরত গেলে মাঠে থাকা আগের কাজগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। সরকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে খামারিদের কোনো মতামত নেয়নি। অথচ প্রকল্পটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে ডেইরি খাতের সরবরাহ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরবে।
প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিপুলসংখ্যক খামারির প্রশিক্ষণ, উৎপাদিত পণ্য ব্যবস্থাপনায় গ্রুপ গঠন, পশু খাদ্য উৎপাদন ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহারসহ বহুমুখী উদ্যোগের কারণে দেশে প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। এ খাতের খামারিদের দক্ষ করে তুলতে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) আওতায় এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে চলমান প্রকল্পটি এরই মধ্যে প্রান্তিক খামারিদের পথ দেখাতে শুরু করেছে। এই প্রকল্প অনিয়ম-দুর্নীতি থাকলে তার তদন্ত করে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। সামনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করা যেতো। কিন্তু তা না করে বিশ্বে ব্যাংকের টাকা ফেরত দিলে দেশেরই ক্ষতি হবে। কারণ এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ খাত বদলে দেওয়ার সুযোগ ছিল। মাথা ব্যাথা হলে মাথা কেটে ফেলার মতো সিদ্ধান্ত নিলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এ বিষয়ে জানতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতারকে গতকাল একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ডলার সংকট ও এলসি জটিলতার কারণে আন্তর্জাতিক দরপত্রের আওতায় অনেক কাজ হাতে নিতে সময় লাগছে। ফলে নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন না হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ জন্য প্রকল্পে জরুরি নয় এমন কাজ বাতিল করা হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সাড়ে ৪ হাজার সেবা নেটওয়ার্ক, প্রতিটি উপজেলায় প্রদর্শনী খামার, ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে গবাদি পশুর টিকা কার্যক্রম, প্রজনন ও বিপাকীয় রোগ নিয়াময়, ৫০টি বিশুদ্ধ জাতের বকনা সংগ্রহ, ৪৬৬ উপজেলায় উন্নত জাতের ঘাস উৎপাদন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ৪৬ খামারে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং উপকূলীয় এলাকায় ২০টি স্থানে নিরাপদ পানির ব্যবস্থাকরণ এবং প্রকল্প এলাকায় সব খামারির ডিজিটাল ডাটাবেজ গঠন করা হয়েছে। প্রকল্পের আতওায় এরই মধ্যে বাজার সংযোগ ও মূল্য শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনায় ১০০টি ছোট ফিড কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। ৩৮০ জন পশুখাদ্য উৎপাদন উদ্যোক্তাকে যন্ত্রপাতি স্থাপনে সহায়তা করা হয়েছে। ৪০০ দুধ সংগ্রহ কেন্দ্র, ২০টি ডেইরি হাব প্রতিষ্ঠা এবং ২৩২টি দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ৪ হাজার ৩৯১টি দুগ্ধ দোহন যন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। ১৪০টি মাংসের স্লটার স্ল্যাব ও জেলা পর্যায়ে ১৮টি মানসম্মত জবাইখানা নির্মাণসহ আরও অনেক কার্যক্রম রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু সহিষ্ণু উৎপাদন পদ্ধতির উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে ২৫টি উদ্যোগ। এরই মধ্যে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬৪০ জন খামারিকে সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয়েছে।
- বিষয় :
- প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর