ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ কূটনীতিকদের

ফাইল ছবি
তাসনিম মহসিন
প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৪ | ১৮:৩৫
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকায় থাকা বিদেশি কূটনীতিকদের অবহিত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছে, চলমান আন্দোলনের আড়ালে সহিংসতা করেছে রাষ্ট্র ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। এ পরিস্থিতি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। খুব শিগগির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলেও জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। তবে এ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের ওপর বিরূপ প্রভাব নিয়ে ব্রিফিংয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন কূটনীতিকরা।
গতকাল রোববার বিকেল ৪টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি কূটনীতিকদের কাছে তুলে ধরতে রুদ্ধদ্বার ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ কূটনীতিকদের ব্রিফ করেন। এ সময় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ব্রিফিংয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাতিসংঘ, জার্মানি, ফ্রান্স, চীন, ভারত, ব্রাজিল, স্পেন, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, ভুটান, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, কানাডা, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসসহ ঢাকার বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশন, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান ও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে অংশ নেওয়া এক রাষ্ট্রদূত নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে জানান, সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপি, জামায়াত, রাষ্ট্র ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এ সময় প্রায় ১৫ মিনিটের ভিডিও দেখানো হয়। কূটনীতিকরা চলমান পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতি, দেশের নাগরিক এবং বাংলাদেশে এর ভয়াবহ প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, ভারতসহ বেশ কিছু দেশ কথা বলেছে। তাদের বেশির ভাগই প্রধানত ইন্টারনেট বন্ধ থাকা এবং কারফিউ ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চেয়েছেন। এ ছাড়া সরকার জানিয়েছে, আদালতের রায়ে শিক্ষার্থীরা খুশি। তবে আন্দোলনে কতজন নিহত হয়েছে, তা ব্রিফিংয়ে জানানো হয়নি।
ব্রিফিংয়ের সময় কূটনীতিকরা বলেছেন, ইন্টারনেট না থাকায় মানুষের জীবন রক্ষায় কাজ করতে পারছে না আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় এনজিওগুলো। বিশেষ করে খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুরসহ যমুনা ও পদ্মাপাড়ের বন্যা উপদ্রুত এলাকার মানুষের জন্য কাজ করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সংকটে যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় ঝুঁকিতে থাকা দরিদ্ররা যে ভাতা পেতেন, সেই কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।
এক কূটনীতিক রোহিঙ্গা সংকট ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে জানিয়ে বলেন, কক্সবাজারের ক্যাম্পে নিরাপত্তা তৎপরতা কমিয়ে দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। ইন্টারনেট না থাকায় সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য পণ্য কেনার ক্ষেত্রেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সরকারকে জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ স্যাটেলাইট ফোন ও অন্যান্য সরঞ্জাম আনতে দেওয়ার সুবিধা দিতে বলেছেন তিনি। এ কূটনীতিক আরও বলেন, ঢাকা শহরের আকাশে জাতিসংঘের লোগোযুক্ত হেলিকপ্টার ও রাস্তায় জাতিসংঘের লোগোযুক্ত ট্যাঙ্ক দেখা গেছে, যা গণমাধ্যমে প্রচারিতও হয়েছে। বিষয়টি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরের দৃষ্টিতে এসেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বৈঠকে কূটনীতিকরা নিরাপত্তা ও কারফিউ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন। তারা পরিষ্কার হতে চেয়েছেন কারফিউ উঠিয়ে নেওয়ার পর কী হবে। দূতাবাসগুলোর কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের এয়ারপোর্ট আসা-যাওয়ার বিষয়গুলো কী হবে। তারা বলেন, দূতাবাসগুলো বন্ধ রয়েছে। তাদের কর্মীরা আসতে পারছেন না।
এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, যে ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়েছে, তা একপক্ষীয়। পুলিশ নিরস্ত্র মানুষের ওপর যে গুলি করছে, তার কোনো ভিডিও নেই। যুক্তরাজ্যের কূটনীতিকও এ সময় পিটার হাসের সঙ্গে একমত হন।
বৈঠকে চীনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশে যা ঘটছে, এটা অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশে থাকা চীনের নাগরিকদের সুরক্ষার বিষয়টি তুলে ধরা হয় সে দেশের পক্ষ থেকে। বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়, খুব শিগগির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে তারা আশাবাদী।
এই ব্রিফিং সকাল ১১টায় হওয়ার কথা ছিল। তবে শেষ মুহূর্তে সময় পরিবর্তন করে বিকেল ৪টায় করা হয়। এ বার্তা সময়মতো সবার কাছে না পৌঁছানোর কারণে অনেক দেশের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিরা সকালে এসে ঘুরে যান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশে চলমান পরিস্থিতিকে অভ্যন্তরীণ বর্ণনা করে তা খুব শিগগির স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে কূটনীতিকদের কাছে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। কূটনীতিকদের উদ্দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর নাশকতার ওপর সংক্ষিপ্ত ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়।
ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্র ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও দুষ্কৃতকারীরা সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে জনগণ ও রাষ্ট্রের সম্পত্তির ওপর হামলা পরিচালনা করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার কূটনীতিকদের 'উদ্বেগ' সম্পর্কে সচেতন রয়েছে। একই সঙ্গে ভিয়েনা সনদের আওতায় কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে সরকার বদ্ধ পরিকর।
উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে কূটনীতিকরা নাশকতাকারীদের ধ্বংসযজ্ঞের তীব্র নিন্দা জানান এবং দেশের পরিস্থিতি শিগগির স্বাভাবিক হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি তারা দ্রুত ইন্টারনেট চালুর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দেশব্যাপী হামলা ও অগ্নিসংযোগ থেকে রাষ্ট্রের সম্পত্তি রক্ষায় পুলিশ বল প্রয়োগে বাধ্য হয়েছে। পুলিশ মানবাধিকার লঙ্ঘন করেনি; বরং রক্ষায় সর্বোচ্চ সচেষ্ট ছিল। একই সঙ্গে প্রতিটি প্রাণহানির বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে সরকার বদ্ধপরিকর।
- বিষয় :
- কূটনীতিক