ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সেমিনারে অভিমত

দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়, তিন নির্বাচন জ্বলন্ত প্রমাণ

দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়, তিন নির্বাচন জ্বলন্ত প্রমাণ

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম- সমকাল

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ১৯:৩৯

নির্বাচনী সংস্কারের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বিগত তিনটি নির্বাচন তার জ্বলন্ত প্রমাণ। কাজেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে নামেই ডাকা হোক না কেন, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তী সরকারের বিকল্প নেই।

শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধে এসব কথা বলেছেন সিলেটে অবস্থিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম। ‘জাতীয় রাষ্ট্রচিন্তা পরিষদ’ আয়োজিত ‘বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন: কার্যকর ও টেকসই সংস্কার’ শীর্ষক সেমিনারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ও গবেষকরা মূল প্রবন্ধটি নিয়ে তাদের অভিমত তুলে ধরেন। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা থাকাসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা তাই বলে। সর্বশেষ ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন তার জ্বলন্ত প্রমাণ। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার পরেও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কারণ, পুরো নির্বাচনটি পরিচালনা করে সরকারের নির্বাহী বিভাগের লোকেরা, আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীরা। নির্বাচন কমিশন সেখানে কেবল লজিস্টিক সাপোর্টস এবং গাইডিং প্রিন্সিপালস সরবরাহ করে মাত্র। তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি প্রশাসনের সদস্যরাই এ–সংক্রান্ত নির্বাহী কার্যক্রম সম্পন্ন করে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আরও বলে, ক্ষমতাসীন সরকার ও দল ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে পরাজয় বরণ করতে একদম নারাজ। নিকট ভবিষ্যতেও এর কোনো ব্যত্যয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।’

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ত্রুটিগুলো দূর করতে এবং বাংলাদেশে নির্বাচনকে সত্যিকার অর্থে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হলে সংস্কারের বেশ কিছু ক্ষেত্র বিবেচনা করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, আইনি সংস্কার এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য পদ্ধতিগত পরিবর্তন।’

বিভিন্ন নির্বাচনের তথ্য উল্লেখ করে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো কমবেশি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। এরপর ৯০–এর দশকের শুরু থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে কয়েকটি নির্বাচন হয়েছিল, এগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে, দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগত্যা পেয়েছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পর যে নির্বাচন হয়েছে, এই নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। এটাই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হওয়ার মূল কারণ। তাই কীভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

সাবেক সচিব ⁠শেখ মুতাহার হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ও সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং কর্মকর্তার দায়িত্বপালনকারীদের বিরাট অংশ থাকেন শিক্ষকরা। এখন সিংহভাগ শিক্ষকই তো দলীয়। প্রাথমিকে দলীয়করণ হলেও তা অনেক কম। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকে দলীয়করণটা বেশি। আর স্কুল কমিটির প্রধান সব আওয়ামী লীগের লোক। তাদের হাতে ক্ষমতা থাকে শিক্ষকদের বরখাস্ত করার। কাজেই শুধু চাইলেই হবে না, হাজারো শিক্ষককে বদলি করতে হবে। এই শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করলে কীভাবে সুষ্ঠু ভোটটা হবে।’

সাবেক সচিব ⁠শেখ মুতাহার হোসেন আরও বলেন, ‘যারা এখন ডিসি-এসপি হচ্ছেন তারা কি নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন? তারা তো দেখবেন আগামীতে কারা ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছেন, তাদের হয়ে তারা কাজ করবেন। এজন্য প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করতে না পারলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।’

বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় দায়িত্বপালনকারী এই সাবেক এই সচিব আরও বলেন, ‘শেখ হাসিনা জাতীয় নির্বাচনটা কলুষিত করেছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রার্থীরা একসময় মানুষজনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখত এবং জানাশোনা পরিচয় হতো। পরে তো কিছু লাগেনি, শেখ হাসিনার সাক্ষর নিয়ে গেলেই হয়ে গেছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নটার প্রয়োজন ছিল না।’

রাষ্ট্রচিন্তা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল লতিফ মাসুম সভাপতির বক্তব্যে বলেন, ‘ব্যক্তি যদি ভাল না হয়, ব্যক্তির মন যদি ভাল না হয় শাসনতন্ত্রের উন্নতি কোনদিনই হবে না। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের পাশাপাশি মানুষের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন আনা দরকার। একইসঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শিক্ষার মাধ্যমে, গণমাধ্যমের মাধ্যমে, সিনেমার মাধ্যমে, নাটকের মাধ্যমে সংস্কার করা দরকার। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে গোটা জাতিকে যদি নৈতিক বিপ্লবের দিকে ঠেলে দিতে হবে। ভাল নির্বাচন দিতে সেরকম মন-মানুষ গড়ে তুলতে হবে।’

সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন জাতীয় রাষ্ট্রচিন্তা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেজবাহ-উল-আজম সওদাগর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তারেক ফজল, নিরাপত্তা বিশ্লেষক জিয়া হাসান ও শেখ বুরহানউদ্দিন কলেজের শিক্ষক ⁠মাহবুবুর রহমান। এছাড়াও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ শাহ আবদুল হালিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক স. ম. আলী রেজা ও সহযোগী অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম এবং ⁠নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ. বি এম মাহবুবুল ইসলাম সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।

আরও পড়ুন

×