ঘোষণা দিয়ে নৈরাজ্য, ঠেকানো যাচ্ছে না তবুও

তিন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্র ডেমরা এলাকা - সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:৪৯ | আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২৪ | ০৮:১২
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বারবার নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হলেও ঠেকাতে পারছে না প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটানো শিক্ষার্থীরা এসব নৈরাজ্যের কারণে বিতর্কিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ হচ্ছে অতিষ্ঠ। তুচ্ছ ঘটনার জেরে সামাজিক মাধ্যমে আগাম ঘোষণা দিয়ে তাণ্ডব চালানো হলেও তা প্রতিরোধে সরকারের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। নানা দাবি নিয়ে বারবার সড়ক বন্ধ করা হচ্ছে। যেসব ঘটনায় শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তা দূর থেকেই দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হচ্ছে না, জনমনে ভীতি কাটছে না।
গতকাল সোমবার যাত্রাবাড়ীতে ডা. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে পুরান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের হামলা ও ভাঙচুরে কেউ নিহত হয়নি বলে নিশ্চিত করলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে– তা বলা হয়নি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ভাষ্যে।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের পতন ঘটানো অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা সারজিস আলম গতকাল ফেসবুকে লেখেন, ‘সবার আগে দেশ, দেশের মানুষ, জনগণের সম্পদ। যদি কেউ বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, সে যে পরিচয়েরই হোক না কেন; দেশের স্বার্থে তাদের প্রতিহত করে জনমানুষের নিরাপত্তা প্রদান করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান কাজ।’
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গতকাল দাবি করেন, রক্তক্ষয় এড়াতেই পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করছে না। তিনি বলেন, পুলিশ বাধা দিলেও শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে পুলিশ ও সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত উপস্থিত থেকে তাদের সরানোর চেষ্টা করে। পুলিশ পাল্টা ব্যবস্থা নিলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হতো। পাল্টা আক্রমণ হলে ছররা গুলি ছোড়ার কাজটি করত। পুলিশে নতুন যারা দায়িত্ব নিয়েছেন, তারা সেটি করবেন। তবে তারা যথেষ্ট সময় পাননি।
নৈরাজ্য ঠেকাতে না পারলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে এবং সাংবাদিকদের ক্যামেরায়ও অনেক কিছু বন্দি হয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সরকার পতনের পর একের পর এক মব জাস্টিস তথা গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। বিক্ষিপ্তভাবে হামলা হয় বিভিন্ন স্থানে। এসব ঘটনা কমার পর বাড়তে থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দলবদ্ধ সংঘর্ষ ও তাণ্ডব। গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় আইডিয়াল কলেজে হামলা করে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। দুই কলেজের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে আরেক শিক্ষার্থীর হাতাহাতির জেরে ঘোষণা দিয়ে এ হামলা হয়। কিন্তু ঠেকাতে কিছুই করেনি পুলিশ।
প্রায় প্রতি বছরই ঢাকা কলেজ এবং সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। তবে গত ২০ নভেম্বরের সংঘর্ষ আগের সব নজিরকে ছাড়িয়ে যায়। ঢাকা কলেজের বাসে ঢিল ছোড়ার ঘটনার জেরে সিটি কলেজে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী হামলা হয়। টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা দোকানে চা পান নিয়ে বিতর্কের মতো তুচ্ছ ঘটনার জেরে গত রোববার রাতে সংঘর্ষে জড়ায়।
শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনের শুরুতেই গত ১৬ জুলাই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এইচএসসির সাত পরীক্ষা হওয়ার পর তা স্থগিত হয়ে যায়। অবশিষ্ট পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে ২০ আগস্ট সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। তাদের দাবি মেনে সরকার অবশিষ্ট পরীক্ষা বাতিল করে।
এর পর থেকে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে নানা দাবিতে সড়কে নামে। রাজধানীর সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুক্ত করে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে দিনের পর দিন সড়ক অবরোধ করলেও, তাদের সরাতে কিছুই করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে ১৮ নভেম্বর শিক্ষার্থীরা মহাখালী রেলগেট অবরোধ করে ট্রেনে পাথর ছোড়ে। এতে শিশুসহ পাঁচ যাত্রী রক্তাক্ত হয়। দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ দ্রুত শুরু করার দাবিতে ১১ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া মেডিকেল টেকনোলজিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নানা দাবিতে গত সাড়ে তিন মাসে সড়ক বন্ধ করেছেন।
চাকরি জাতীয়করণ, বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতিসহ নানা দাবিতে আনসার, আউটসোর্সিং কর্মী, শিক্ষক, কর্মচারীসহ বিভিন্ন পেশার সরকারি চাকরিজীবীরা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর সবচেয়ে বেশি সড়ক বন্ধ করেছেন। যথেচ্ছ সড়ক বন্ধ, অযৌক্তিক দাবিতে রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেললেও, এইচএসসি পরীক্ষায় ফেল করে পাসের দাবিতে সচিবালয়ে ঢুকে পড়া পরীক্ষার্থী এবং আনসার সদস্য ছাড়া আর কারও বিরুদ্ধে কঠোর হয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ব্যবস্থাও নেয়নি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারি বাসভবন যমুনাও ঘেরাও হচ্ছে মাঝেমধ্যে। বাদ যায়নি উচ্চ আদালতও। পুরান ঢাকায় রোববারের তাণ্ডবের ঘটনায় মামলা হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
গত ১৯ নভেম্বর হাইকোর্ট রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা তিন দিনের মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার পরদিন থেকেই ঢাকার বিভিন্ন সড়ক বন্ধ হচ্ছে চালকদের আন্দোলনে। শুক্রবার জুরাইনে সংঘর্ষ হয় পুলিশের সঙ্গে।
সব নৈরাজ্যকেই ছাড়িয়েছে গত দু’দিনে পুরান ঢাকা ও যাত্রাবাড়ীর তাণ্ডব। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদার ১৮ নভেম্বর ডেঙ্গুতে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে অভিযোগে তাঁর সহপাঠীরা হাসপাতালে ভাঙচুর চালায়।
৩৫ বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত ‘ইউনাইটেড কলেজ অব বাংলাদেশ (ইউসিবি)’ নামে একটি ফোরামের ফেসবুক পেজ থেকে ‘সুপার সানডে’ ঘোষণা দিয়ে রোববার ন্যাশনাল হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজে তাণ্ডব-লুটপাট চালানো হয়। পেজটি থেকে শিক্ষার্থীদের লাঠি, স্টাম্প ও হাতুড়ি নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল।
সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের পেজ থেকে এ হামলার প্রতিশোধ নিতে ফেসবুক পেজে ‘মেগা মানডে’ ঘোষণা করা হয়। লাঠি ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তারা গতকাল মোল্লা কলেজে তাণ্ডব ও লুটপাট চালায়। পুলিশের ভাষ্য, পুরান ঢাকা এবং যাত্রাবাড়ী মোড়ে বাধা দিয়েও ঠেকানো যায়নি। তাণ্ডব চলাকালে ফেসবুকে শিক্ষার্থী নিহতের গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করা হয়।
আগাম ঘোষণা দিয়ে তাণ্ডব হলেও কেন ঠেকানো যাচ্ছে না– এমন প্রশ্নে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘পুলিশে বড় পরিবর্তন এসেছে।
প্রশাসনেও বড় পরিবর্তনের পরিকল্পনা চলছে। সেগুলো নস্যাৎ করতেই এসব হচ্ছে কিনা সন্দেহের বিষয়। এক দিনে এতগুলো ঘটনা কাকতালীয় নয়। নিশ্চয় কারও বা কোনো পক্ষের ইন্ধন রয়েছে। আমরা তদন্ত করে দেখছি, সরকার সফলভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রম করুক, এটা অনেকেই হয়তো চাইছে না।’
সরকারের আরেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বাম এবং ডান মানসিকতার কতিপয় নেতৃত্ব বা ব্যক্তি গণঅভ্যুত্থানে এবং পরবর্তীতে সরকারে নিজেদের শরিকানা নিশ্চিত না করতে পেরে উন্মত্ত হয়ে গেছেন। তাদের উন্মত্ততা, বিপ্লবী জোশ এবং উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড দেশটাকে অস্থির করে রেখেছে। অনেক মিত্রই আজ হঠকারীর ভূমিকায়। আমরা আমাদের ব্যর্থতা স্বীকার করি। আমরা শিখেছি এবং ব্যর্থতা কাটানোর চেষ্টাও করছি’।
অভ্যুত্থানে বীরত্ব দেখিয়ে দেশকে মুক্ত করা শিক্ষার্থীরা তাণ্ডব-সংঘর্ষে জড়িয়ে বিতর্কিত হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সড়ক অবরোধ না করে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি নিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গতকাল বলেছেন, ন্যায্য দাবি পূরণ করা হবে। রাস্তায় নামতে হবে না। তবে অন্যায্য কোনো দাবি মানা হবে না।
ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে মানুষ অতিষ্ঠ। এর সমাধান কোথায়? এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা উপদেষ্টা আরও বলেন, শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, শিক্ষক, শ্রমিক ও বহু সংগঠন ঢাকা শহরে আন্দোলন করছে। তারা সড়ক আটকাচ্ছে। কিছু ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। আন্দোলনও এখন আর নেই। আবার অন্যরা আন্দোলন করছে। ন্যায্য দাবি না হলেও রেললাইন অবরোধ করা হচ্ছে, যাত্রীদের আক্রমণ করা হচ্ছে। এগুলো করলে জনগণই তাদের বিরুদ্ধে যাবে, যারা অন্যায্য দাবি নিয়ে জনগণকে কষ্ট দেয়, জনগণই তাদের প্রতিরোধ করবে।
শিক্ষকদের দিক থেকেও শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিরোধে জড়ানো তিন কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে গতকাল রাতে বৈঠকে বসতে চেয়েছিল। কিন্তু শিক্ষকরা অন্য প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে আলোচনায় বসতে রাজি হননি। কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এটা আলোচনার সময় না। শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত আছি।’
সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ কাকলী মুখোপাধ্যায় বলেন, মোল্লা কলেজের সঙ্গে আলোচনায় বসলে আমাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বেইমানি করা হবে।