নজিরবিহীন ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউট সারাদেশে

প্রতীকী ছবি
হাসনাইন ইমতিয়াজ
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৪ | ০৩:৫৩
চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে দেশ ইন্টারনেটবিহীন। বাংলাদেশ এত দীর্ঘ সময় কখনও ইন্টারনেট সেবার বাইরে ছিল না। নজিরবিহীন এ ঘটনায় দেশের অনলাইনভিত্তিক আর্থিক সেবা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। যোগাযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ। দ্রুত সংবাদ আদান-প্রদান ও তথ্য যাচাই ব্যাহত হচ্ছে। অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে। এতে আরও বেশি গুজব ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইন্টারনেট সেবা কখন চালু হবে– এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিতভাবে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সূত্র জানিয়েছে, চলমান সহিংস পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকতে পারে।
জানা গেছে, চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও গুরুত্বপূর্ণ কলেজ এলাকায় ফোরজি সেবা সীমিত করা হয়। বুধবার থেকে সারাদেশের ফোরজি সেবা বন্ধ করে দেয় মোবাইল অপারেটরগুলো। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নির্দেশে অপারেটররা এই পদক্ষেপ নেয়।
এরপর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মহাখালীতে আগুনে সার্ভার ও কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ট্রাফিক কমে যায়। সেদিন রাত ৯টা থেকে দেশজুড়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে।
বিটিআরসির পক্ষ থেকে মহাখালীর আগুনকে এ জন্য দায়ী করা হলেও কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আইআইজি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যান্ডউইথ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় ব্রডব্যান্ড সেবা পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে।
ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান আইএসপিবির সভাপতি ইমদাদুল হক সমকালকে জানান, মহাখালীতে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা ভবনে আগুন দেওয়ায় পাশের খাজা ভবনে থাকা ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সার্ভার ডাউন রয়েছে। তিনি বলেন, এ এলাকায় তিনটি ভবনে ডেটা সার্ভারসহ বিভিন্ন ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা থেকে দেশের ব্রডব্যান্ডের ২৫ শতাংশ ট্রাফিক হয়। আগুনে এই সেবা ব্যাহত হচ্ছে। তবে পুরো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণ আইআইজিগুলো ব্যান্ডউইথ দিচ্ছে না।
একটি অপারেটরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ব্যান্ডউইথ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
চালু হবে কবে
মোবাইল ফোনে ফোরজি চালু কবে হবে– এমন প্রশ্নের জবাবে গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথকভাবে জানানো হয়, বিষয়টি কর্তৃপক্ষের (বিটিআরসি) ওপর নির্ভর করছে।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, তারা চেষ্টা করছেন দ্রুততম সময়ে সেবাটি চালু করতে।
আইএসপিবির সভাপতি ইমদাদুল হক বলেন, মহাখালীর দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত কেবল সারাতে আরও এক দিন সময় লাগতে পারে। এর বাইরে আইআইজিগুলো ব্যান্ডউইথ সরবরাহ শুরু করলেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু হবে।
একটি মোবাইল অপারেটর আর একটি কেবল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, সহিংস পরিস্থিতির উন্নতি হলেই সেবাটি চালু হবে।
টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দ্রুত সংযোগ দেওয়া হবে।
দ্রুত ইন্টারনেট সেবা চালুর দাবি সম্পাদক পরিষদের
গতকাল শুক্রবার বিবৃতিতে দেশের প্রধান সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ দ্রুত ইন্টারনেট সেবা চালুর দাবি করেছে। সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার রাত থেকে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রয়েছে। ফলে দ্রুত সংবাদ আদান-প্রদান ও তথ্য যাচাইয়ের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। সম্পাদক পরিষদ মনে করে, এভাবে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ব্ল্যাক আউটের আশঙ্কা তৈরি করে, ফলে গুজব এবং মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ অবস্থায় তারা দ্রুত সারাদেশে ইন্টারনেট সেবা চালুর জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
বন্ধ অনলাইন যোগাযোগ
ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ব্যবহার বন্ধ রয়েছে। অনলাইনে ফোন বা বার্তা আদান-প্রদান করা যাচ্ছে না। মেইলসহ সব ধরনের অনলাইন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। অননেট কল বন্ধ হওয়ায় বেড়ে গেছে অফলাইন ভয়েস কল। এতে ভয়েস কলের মানও কমে গেছে। কলড্রপ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোর সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধনসহ অনলাইনভিত্তিক নাগরিক সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে নাগরিকরা।
এদিকে সেবা বন্ধ থাকায় ছোট ইন্টারনেট প্যাকেজ কেনা গ্রাহকদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন গ্রাহকরা। তবে মোবাইল অপারেটররা বলছে, তারা সরকারের নির্দেশে সেবা বন্ধ রেখেছে। তাই ক্ষতিপূরণ দিতে হলে সরকারকেই দিতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, প্রযুক্তির এ যুগে ইন্টারনেট বন্ধ করে সহিংসতা ঠেকানো যায় না। বরং এতে গুজব আরও ডালপালা মেলে।
ব্যাহত আর্থিক সেবা
ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে আর্থিক সেবা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে অনেকে ঘরে বসে বিভিন্ন বিল পরিশোধের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন। অনেক এটিএম বুথ বন্ধ রয়েছে। আবার কোনো কোনো বুথে টাকা মিলছে না। বৃহস্পতিবার শাটডাউনের পর গতকাল শুক্রবার অনেকেই ঘরে বসে অনলাইনে বিল পরিশোধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এটিএম বুথ থেকে লেনদেনের সুযোগ থাকলেও হামলার শঙ্কায় অনেক এটিএম বুথ বন্ধ রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও এটিএম বুথে টাকা ছিল না। ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নিয়ে নতুন করে আর টাকা ‘ফিডিং’ করছে না। আবার ইন্টারনেট ব্যাংকিং করতে না পারায় মোবাইল ব্যাংকিংয়েও টাকা স্থানান্তরের সুযোগ পাচ্ছে না।
সাধারণত সাপ্তাহিক ও অন্যান্য ছুটির দিন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে লেনদেনের চাপ থাকে। আর ছুটির আগে ও পরে শাখায় টাকা জমা ও উত্তোলনের চাপ বেশি থাকে। বুধবার সরকারি ছুটির পর গত বৃহস্পতিবার ছিল ব্যাংক খোলা। তবে কোটা সংস্কারের পক্ষে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’-এর কারণে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে শহরকেন্দ্রিক ব্যাংক শাখা ছিল প্রায় ফাঁকা। ব্যাংকারদের উপস্থিতিও ছিল কম। অধিকাংশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও ঢাকার শাখা এদিন প্রধান ফটক আংশিক খোলা রেখে লেনদেন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান ফটকও ছিল বন্ধ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, ব্যাংকিং অ্যাপ ইন্টারনেট-ভিত্তিক হওয়ায় এটা কাজ করছে না। তবে শাখাগুলো পয়েন্ট টু পয়েন্ট ডেটা সংযোগের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। ফলে ইন্টারনেট বন্ধ থাকলেও কেউ শাখায় এলে লেনদেন করতে সমস্যা নেই। আর টুজি সেবায় পয়েন্ট অব সেলস লেনদেন (পিওএস) সেবা চালু আছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে টেলিফোন অপারেটরদের দিক থেকে সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের বাইরে থেকে রেমিট্যান্স পাঠানো বা অন্যান্য লেনদেনেও সমস্যা নেই।
যশোরে সরকারি একটি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক বলেন, বৃহস্পতিবার গ্রাহক উপস্থিতি ছিল খুব কম। আবার ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় অ্যাপ থেকেও টাকা স্থানান্তর করতে না পেরে বিভিন্ন সমস্যা হয়েছে। তিনি বলেন, অনেকে এখন অ্যাপ থেকে ইউটিলিটি বিল বা বিভিন্ন ব্যক্তি এমএফএস থেকে বিভিন্ন বিল পরিশোধ করছেন। তবে এসব করতে না পারায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন অনেকে।
সার্ভার ডাউন থাকায় ফ্লাইট বাতিল
ইন্টারনেট না থাকায় এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষের সার্ভার ডাউন রয়েছে। এতে ঢাকা থেকে বিদেশি এয়ারলাইন্সের কমপক্ষে ১৫-১৬টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. আবদুল্লাহর গতকাল শুক্রবার দুপুর ২টায় সৌদি এয়ারলাইন্সের এসভি-৮০৭ ফ্লাইটে ঢাকা থেকে জেদ্দা ফেরার কথা ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মসূচির কারণে বৃহস্পতিবার রাতে মালপত্রসহ তিনি বহু কষ্টে বিমানবন্দরে পৌঁছেন। কিন্তু আগে থেকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে ফ্লাইটের সময় যাত্রা বাতিল করা হয়।
এ ব্যাপারে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক কামরুল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে বিমানবন্দরের তথ্যকেন্দ্র সূত্র জানায়, ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক রুটের ১৪টি ফ্লাইট বাতিল হয়।
- বিষয় :
- ইন্টারনেট সেবা