দেননি ভর্তি পরীক্ষা, হয়ে যাচ্ছেন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট
জালিয়াত চক্র রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদে

ফাইল ছবি
তবিবুর রহমান
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৫০
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শ্যামলী ম্যাটসের ২০২১-২২ বর্ষের শিক্ষার্থী অপ্সরা দেবনাথ। একাডেমিক বর্ষ অনুযায়ী আর এক বছর পর মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ার সনদ পাবেন তিনি। খালি চোখে বিষয়টি স্বাভাবিক মনে হলেও তাঁর ভর্তিতে হয়েছে ভয়াবহ জালিয়াতি। অপ্সরা ভর্তি পরীক্ষায় অংশই নেননি। পরীক্ষা দিয়ে পাস করা অজয় দেবনাথ নামে এক ছেলের আসনে ভর্তি দেখানো হয়েছে তাঁকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেটাবেজ অনুযায়ী এখনও অজয় পড়াশোনা করছেন। শুধু এটিই নয়, এমন জালিয়াতি অনেক ঘটছে স্বাস্থ্যসেবা শিক্ষায়।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলে (ম্যাটস) পরিচালনা করা হয় চার বছর মেয়াদি কোর্স। সারাদেশে সরকারি ১৬টি ম্যাটসে ১ হাজার ৩২টি আসনে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন। বেসরকারি ১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠানে ২ হাজার ২২০টি আসন রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি ম্যাটসে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রীয়ভাবে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়া হয়। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা পড়ার সুযোগ পান। তবে পরীক্ষায় অংশ না নিয়েই ভর্তি হচ্ছেন অনেকে।
পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্লাবন কুমার দাসের জায়গায় মো. লৌহে মারুফ প্লাবন পড়ছেন। আনিকা রানীর স্থানে অনিক নন্দী পড়ছেন। গত কয়েক বছরে এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া ৩৯ জনের তালিকা পেয়েছে সমকাল। এসব জালিয়াতির কারিগর রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের একটি চক্র। তাদের হোতা অনুষদের সাবেক সচিব ডা. মো. জাহিদুর রহমান, সাবেক সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. ইমরুল কায়েস এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা রেহেনা পারভীন।
ম্যাটসের ভর্তি পরীক্ষা স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে হলেও এসব শিক্ষার্থীর কোর্স কারিকুলাম পরিচালনা করে ও সনদ দেয় রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ। মূলত এই তিনজন এসব শিক্ষার্থীর ভর্তির তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্বে ছিলেন। চক্রটির বিরুদ্ধে অতীতে দুর্নীতি ও অনিয়মের অনেক অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তবে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।
সমকালের হাতে আসা নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চারটি ম্যাটস কলেজে এই শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে শ্যামলী ম্যাটসে সাতজন, ট্রমা ম্যাটসে ১০ জন ও ট্রমা আইএমটিতে আটজনকে ভর্তি করা হয়। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ট্রমা ম্যাটসে ৯ জন, ট্রমা আইএমটিতে একজন ও শ্যামলী ম্যাটসে ছয়জন এভাবে ভর্তি হন। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ইমরুলের স্ত্রী তানজিনা খান।
জানা যায়, ইমরুল পড়াশোনা শেষ করে ২০০৪ সালে ক্যাশিয়ার হিসেবে ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি ও ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট কোর্সের একাডেমিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রক সংস্থায় যুক্ত হন। কাজের সুবাদে তাঁর পরিচয় হয় সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হকের ছেলে মো. জিয়াউল হকের সঙ্গে। ২০০৯ সালে মন্ত্রীর ছেলের সঙ্গে ইমরুলের স্ত্রী তানজিনা খান পার্টনারশিপে ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে তানজিনার নামেই রয়েছে আটটি নার্সিং কলেজ।
সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার ১৭(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া একজন সরকারি কর্মচারী তাঁর এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় নিজের পরিবারের কোনো সদস্যকে কোনো ধরনের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার বিষয়ে অনুমতি দিতে পারবেন না।’ তবে এ নিয়মের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন ইমরুলের স্ত্রী। এ অভিযোগে ২০১৬ সালে ইমরুল ও তাঁর স্ত্রীর নামে মামলা হয়। মামলা হলে চিকিৎসক পরিষদের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হয়। তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ মিললেও তাঁকে কেবল তিরস্কার করা হয়।
সমকালের হাতে আসা নথিতে এসব শিক্ষার্থীর নাম, রোল নম্বর পাওয়া গেছে। এগুলো একাধিকবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বাছাই করে জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছেন। ভর্তি রোলের সঙ্গে কারও নামের মিল পাওয়া যায়নি। চার প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে অধ্যয়নরত কোনো শিক্ষার্থীর তথ্যই পাওয়া যায়নি ওয়েবসাইটে। যারা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাদের তথ্য ওয়েবসাইটে এখনও রয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে অনুষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা রেহেনা পারভীন সমকালকে বলেন, ‘ওয়েবসাইট দেখে তথ্য বাছাইয়ের সুযোগ আমাদের নেই। যে ফর্মটি আমাদের দেওয়া হয়, সেই ফর্মটির রোল ঠিক আছে কিনা, সেটি শুধু দেখি। জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তির সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই।’
অনুষদের সাবেক সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. ইমরুল কায়েস সমকালকে বলেন, ‘তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্বে থাকেন অফিস সহায়করা। তারা সবকিছু ঠিক দেখে আমাদের কাছে কাগজ পাঠান। সেখানে শুধু রোল নম্বর দেওয়া থাকে। আমরা শুধু স্বাক্ষর দিয়ে থাকি। সারাদেশে ম্যাটসে চার হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। এ কারণে তথ্য বাছাই করা একটু কঠিন।’ স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মালিক আমার স্ত্রী নয়। আমার স্ত্রীর শেয়ার থাকতে পারে।’ অভিযোগের বিষয়ে ইমরুলের স্ত্রী তানজিনা খান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে অনুষদের সাবেক সচিব ডা. জাহিদুর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও সাড়া মেলেনি।
জানা গেছে, এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে একটি পক্ষ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ অভিযোগ আমলে নিয়ে গত ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় চিকিৎসক অনুষদকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। অনুষদের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অনুষদের ভারপ্রাপ্ত সচিব ডা. মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেন, ‘এমন একটা অভিযোগ এসেছে। আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। দু-একদিনের মধ্যে কমিটির কার্যক্রম শুরু হবে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন সমকালকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। অভিযোগ প্রমাণ হলে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
- বিষয় :
- মেডিকেল ও ডেন্টাল শিক্ষার্থী