বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক্সেও সংঘবদ্ধ অপপ্রচার

ছবি: সমকাল
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৪:৫৭ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৮:৪৪
ফেসবুকের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সেও (সাবেক টুইটার) চলছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় আক্রান্ত, মূলত এমন ভুয়া তথ্য বেশি ছড়ানো হচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অপতথ্য ছড়ানোর হার অস্বাভাবিক বেড়েছে। ভারতভিত্তিক বা ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট থেকে এমন অপপ্রচার বেশি ছড়ানো হচ্ছে। অপতথ্য ছড়াতে এক্সে নতুন আইডি খোলার হার বেড়েছে ২১৪ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক সংস্থা টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গত ২৬ জুলাই থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত চার মাসে এক্সে বাংলাদেশের রাজনীতিবিষয়ক দৈবচয়নের ভিত্তিতে এক হাজারের বেশি পোস্ট সংগ্রহ করা হয়। এসব বিশ্লেষণ করেই প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। অপতথ্য যাচাইয়ে ব্যবহার করা হয়েছে মেটার থার্ড পার্টি ফ্যাক্টচেক রেটিং ফ্রেমওয়ার্ক। এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন শামস ওয়াহিদ শাহাত, আপন দাস ও মোহাম্মদ আরাফাত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছাড়াও অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছেন ব্যবহারকারীরা। আগস্টে অপতথ্য ছড়ানোর ক্যাম্পেইন সবচেয়ে বেশি চলেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে, যা প্রায় ৭৭ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ৩৫ শতাংশ কনটেন্ট এক্স, ফেসবুক ও ইউটিউবে একত্রে ছাড়া হয়েছে। অক্টোবরে ফেসবুক ও ইউটিউবে ছাড়া হয়েছে ২৩ শতাংশ। নভেম্বরে ভাইবার, মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো ব্যক্তিগত মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে ৭১ শতাংশ। নতুন অ্যাকাউন্টগুলোর ৭৪ শতাংশ ভুল তথ্যসংবলিত পোস্ট করেছে। অপ্রাসঙ্গিক তথ্য প্রকাশ করেছে ২৪ শতাংশ। আর পরিবর্তন ও সহিংসতার ডাক দেওয়া পোস্ট ছিল ১ শতাংশ। অপতথ্য ছড়াতে অনেক ক্ষেত্রে ভেরিফায়েড মার্ক ব্যবহার করে সবাইকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। শীর্ষ ২০ হ্যাশট্যাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল #সেভহিন্দুসইনবাংলাদেশ এবং #বাংলাদেশিহিন্দুসজেনোসাইড।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং পলিসি ফেলো সাবহানাজ রশীদ দিয়া ফেসবুকে প্রতিবেদনটি শেয়ার করে লিখেছেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ও উস্কানি ছড়াতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার হয়েছে।
প্রতিবেদনে ভুল তথ্য ছড়ানোর কয়েকটি পন্থার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, রাশিয়া ও চীন এমন পন্থা অনুসরণ করে ভুয়া তথ্য ছড়ায়। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলের একটি ঘটনার ছবি দিয়ে তথ্য ছড়ানো হয়, বাংলাদেশে শরিয়াহ আইন ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলামিস্টরা ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের উৎপীড়ন করছেন। বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেকাররা জানান, ছবির ব্যক্তিটির নাম জুবায়ের আলী। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন এবং হিযবুত তাহরীরের কেউ না। পরে তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়।
একইভাবে ১৩ অক্টোবর রাধারমন দাস নামের আইডি থেকে দুই তরুণীর ছবি ছড়িয়ে দাবি করা হয়, বিজয়া দশমী থেকে ফেরার পথে দুই হিন্দু নারীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, পূজা বিশ্বাস ও রত্না সাহা নামে ফরিদপুরের দুই ছাত্রী পূজা উৎসব থেকে ফেরার পর বিষক্রিয়ায় (বিষাক্ত মদপান) মারা যান। ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের হাজারি গলির ঘটনা নিয়ে ৬ নভেম্বর বাবা বানারস আইডি থেকে কিছু ভিডিও ছড়িয়ে দাবি করা হয়, জামায়াত এবং সেনাবাহিনীর হামলায় ৫০ হিন্দু হতাহত হয়েছেন। ফ্যাক্টচেকার প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার জানায়, চট্টগ্রামে একটি বিক্ষোভে কয়েকজন আহত হয়েছেন। কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। এ ছাড়া তিন মাসে ২৭ হাজার হিন্দুকে হত্যার তথ্য ছড়ানো হলে সে তথ্য মিথ্যা বলে জানান ফ্যাক্ট চেকাররা।
অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সখ্য আছে বলে অপতথ্য ছড়ানো হয়। ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, জেএমবি, হুজির মতো জঙ্গিগোষ্ঠীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। পরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, এমন ঘটনা ঘটেনি। একইভাবে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, সেখ বশির উদ্দিন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও মাহফুজ আলমের বিরুদ্ধেও চরমপন্থি ও পাকিস্তানি জঙ্গির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা তোলা হয় এক্স ও ভারতীয় কিছু গণমাধ্যমে।
ফ্যাক্ট চেকাররা জানান, এসব অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারসহ নানা ইস্যুতে ভারতীয় গণমাধ্যম এবং এক্সে অপতথ্য ছড়ানো হয়। এ জন্য ব্যবহার করা হয় চটকদার ছবি ও ভিডিও। যার সব তথ্যই ভুয়া।
বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভারতীয় ডানপন্থি বা অতি জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ উদ্বুদ্ধ করে–এমন কনটেন্ট বেশি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ভারতের ডানপন্থি গণমাধ্যম, যেমন রিপাবলিক বাংলা বা আপইন্ডিয়া থেকে শেয়ার করা বিষয়বস্তু বা সরাসরি উদ্ধৃতি রয়েছে, যেখানে হিন্দি ভাষার ব্যবহার বেশি। এসব পোস্টে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের ট্যাগ করা হয়।
টেক গ্লোবাল বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ঘিরে অপতথ্য বাড়ার সঙ্গে বিদেশিদের জড়িত থাকার বিষয়টি উদ্বেগজনক। যদিও চীন, ইরান, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশগুলোর অপতথ্যের ক্যাম্পেইনের চেয়ে বাংলাদেশের ঘটনা ছোট। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব অপতথ্যের ব্যাধি কার্যকরভাবে মোকাবিলায় ভূরাজনীতি বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈদেশিক নীতির পর জোর দেওয়া প্রয়োজন।