ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ফিরছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা, গণভোট

ফিরছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা, গণভোট

কোলাজ

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:২১ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:২৯

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এবং গণভোট পুনর্বহাল করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি সংবিধানবহির্ভূতভাবে ক্ষমতা দখলবিষয়ক ৭-এর ক ও খ অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে গণ্য করে প্রচলিত আইনে তার সর্বোচ্চ দণ্ডের কথা বলা রয়েছে। এর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচলিত ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেল। এ ছাড়া নির্বাচনী ব্যবস্থার বাইরে ক্ষমতাসীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও বৈধতা পেয়েছে।

বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার পঞ্চদশ সংশোধনী-সংক্রান্ত মামলার এ রায় দেন। সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে জনাকীর্ণ এজলাসে প্রায় দুই ঘণ্টা রায় পাঠ করেন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।

মামলায় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৫৪টি অনুচ্ছেদ সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপনের বিষয় চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। তবে হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরো বাতিল হচ্ছে না। পাঁচটি বিষয় পর্যালোচনা করে এ রায় দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের অন্যান্য অনুচ্ছেদ-সংশ্লিষ্ট বিষয় নির্বাচিত সংসদের এখতিয়ার। সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে বিধানগুলো সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে। ফলে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সন্নিবেশিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা, জাতীয় চার মূল নীতিসহ অন্যান্য বিষয় বহাল থাকছে। তবে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, গণভোটসহ অন্যান্য বিষয় সংবিধানে কীভাবে যুক্ত হবে– বিষয়টি এখনও স্পষ্ট হয়নি। আইনজ্ঞরা বলছেন, হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর বিস্তারিত জানা যাবে।

এদিকে হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন মামলা-সংশ্লিষ্ট রিটকারী ও আইনজীবীরা। তারা বলছেন, এ রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পথে বড় বাধা কাটল। গণভোটের বিধানও ফিরে এসেছে। অর্থাৎ রায়ের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, এটি জনগণের বিজয়। 

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়। এর পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পদ্ধতি নির্ধারণে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। এরই মধ্যে ১৮ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি। পরদিন ওই রিটের শুনানি নিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অবৈধ হবে না– তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

পরে এই রুলের শুনানিতে বিএনপি, জামায়াত, গণফোরাম, ইনসানিয়াত বিপ্লবসহ কয়েকটি দল পক্ষভুক্ত হয়। এ ছাড়া গত অক্টোবরে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ১৭টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রাণীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনও হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। পরে এই রিটের শুনানি নিয়েও রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল রায় দেন হাইকোর্ট।

আদালতে রিট আবেদনের ওপর রাষ্ট্রপক্ষে রুলের শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের বিষয়ে রিটকারী বদিউল আলম মজুমদারের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরিফ ভূঁইয়া। বিএনপির পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, বদরুদ্দোজা বাদল, রুহুল কুদ্দুস কাজল প্রমুখ। এ ছাড়া জামায়াতের পক্ষে শিশির মনির ও ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিকী, ইনসানিয়াত বিপ্লবের পক্ষে ইশরাত হাসান এবং চার আবেদনকারীর পক্ষে জুনায়েদ আহমেদ চৌধুরী ও ইন্টারভেনর হিসেবে হামিদুল মিসবাহ শুনানি করেন। গতকাল রায় ঘোষণার সময় অ্যাটর্নি জেনারেলসহ বিএনপি ও অন্যান্য দলের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং মামলা-সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।

১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর দেশে কোনো সাংবিধানিক সংশোধনী ছাড়াই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় দেন সুপ্রিম কোর্ট। আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে আনা পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে পাস হয়। গেজেট প্রকাশ হয় ২০১১ সালের ৩ জুলাই।

সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও যুক্ত করা হয়। আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান থাকলেও ওই সংশোধনীতে সংযোজন করা হয় পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়টি। 

পর্যবেক্ষণসহ রায়
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে রায়ে বলা হয়, আপিল বিভাগের রায়ে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে সেটি না করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা উপেক্ষা করা হয়েছে। এই ব্যবস্থা বিলুপ্তির পর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি সংসদ নির্বাচনে জনগণের আস্থার প্রতিফলন ঘটেনি। এই তিন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার পাশাপাশি জনগণের আস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। রায়ে বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক-সংক্রান্ত ৫৮ক অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হয়।

এ প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল। এটি সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি হয়ে গেছে। তবে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোই ধ্বংস করা হয়। 

অন্যদিকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নেওয়া সংক্রান্ত ৭ ক অনুচ্ছেদে (১) বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায় (ক) এই সংবিধান বা ইহার কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা (খ) এই সংবিধান বা ইহার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে তাহার এ কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে। এই অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।

সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য সংক্রান্ত ৭ ‘খ’তে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।

হাইকোর্টের রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনীতে যুক্ত হওয়া ৭ (ক) ও ৭ (খ) অনুচ্ছেদ দুটি বাতিল করা হয়। এ প্রসঙ্গে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সংবিধান অনুযায়ী জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। সংবিধান হলো আমাদের সর্বোচ্চ আইন, ৭ অনুচ্ছেদ হলো এর ধ্রুবতারা। পঞ্চদশ সংশোধনী মাধ্যমে সংবিধানের এই মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করা হয়েছিল। এ সময় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাধ্যমে গত ৮ আগস্ট গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রসঙ্গ তুলে ধরে হাইকোর্ট বলেন, জনগণের এই শক্তির বহিঃপ্রকাশ কেউ ঠেকাতে পারে না। 

হাইকোর্টের রায়ে সংবিধানের ৪৪ (২) অনুচ্ছেদও বাতিল করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এ সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটাইয়া সংসদ আইনের দ্বারা অন্য কোন আদালতকে তাহার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ওই সকল বা উহার যে কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা দান করিতে পারিবেন। এ প্রসঙ্গে হাইকোর্ট বলেন, সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ উচ্চ আদালতকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, তা পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অধস্তন আদালতকেও দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের ক্ষমতা খর্ব হয়েছে। এ জন্য এ অনুচ্ছেদটি রায়ে বাতিল করা হয়।

সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক বিষয় নিয়ে দেশে তিনবার গণভোট হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭৭ ও ১৯৮৫ সালে প্রশাসনিক এবং ১৯৯১ সালে সাংবিধানিক গণভোট হয়। এ প্রসঙ্গে হাইকোর্ট রায়ে বলেন, গণভোটের বিধান বিলুপ্ত করা হয়, যেটি সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অংশ ছিল। এটি ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীতে যুক্ত হয়। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের গণভোটের বিধান বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হলো। ফলে দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হলো।

সার্বিক পর্যবেক্ষণ
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সংবিধান হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আইন। অন্য সব আইনই সংবিধানের নিরিখে বিচার্য হবে। আর সুপ্রিম কোর্ট হচ্ছে সংবিধানের অভিভাবক। যে কোনো আইনেরই বৈধতা অবৈধতা নিরূপণ করবে সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধান শুধু অতীত এবং বর্তমানকে নিরূপণ করে না, এটা ভবিষ্যতে কোনো উদ্ভূত বিষয়ের জন্যও। একইভাবে সংবিধান কেবল দালিলিক নথি নয়, এটি একটি জীবন্ত দলিলও। এতে আরও বলা হয়, একটি সংবিধান একটি জাতির ভিত্তি এবং মৌলিক নির্দেশক, যা উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য। সংবিধান হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক বিকাশমান এবং পরিবর্তনশীল।

সাংবিধানিক ও আইনগত পরিবর্তনগুলো সংবিধানের মৌলিক কাঠামো অনুযায়ী করতে হবে। পঞ্চদশ সংশোধীর মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়; যদিও মৌলিক কাঠামো অসংশোধনযোগ্য।

গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে বলেন, সরকারকে বিতাড়িত করতে গিয়ে হাজার হাজার হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জনগণের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে একটি নতুন গণতন্ত্র, নতুন স্বাধীনতা, নতুন বাংলাদেশ; যা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। পঞ্চদশ সংশোধনী জনগণের এসব আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।

যা বহাল থাকছে
হাইকোর্টে আলাদা রিটে পঞ্চদশ সংশোধনীতে যুক্ত হওয়া তপশিল, প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদসহ ৫৪টি বিষয় চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। তবে হাইকোর্ট এর মধ্যে ৫টি বিষয়ে পর্যবেক্ষণসহ রায় দিয়েছেন। ফলে উল্লিখিত ৫টি বিষয় ছাড়া অন্য সব বিষয় বহাল থাকছে। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে জাতীয় চার মূল নীতি– জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাহাত্তরের মূল সংবিধান অনুযায়ী পুনর্বহাল করা হয়। পাশাপাশি সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত হওয়া রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও বহাল রেখে অন্যান্য ধর্মের সমমর্যাদা নিশ্চিত করার বিধান আনা হয়।

এ ছাড়া ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। একইভাবে পরবর্তী সময়ে সংরক্ষিত নারী আসন ৫০-এ উন্নীত করার পাশাপাশি ২০২১ সালে জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। রিটে এগুলো চ্যালেঞ্জ করা হলেও নির্বাচিত সংসদের এখতিয়ার উল্লেখ করে তা বহাল রাখা হয়েছে। একইভাবে বহাল থাকছে বিচারপতি অপসারণ-সংক্রান্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের নিরাপত্তায় বিষয়টিও।

আদালতের ধন্যবাদ জ্ঞাপন
রায়ের পর রিটকারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, ‘এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিয়ে আপনারা একজন নারী বিচারপতির বেঞ্চে এসেছিলেন। একজন নারী বিচারপতির ওপর আস্থা রেখেছেন। এ কারণে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এটা আমার জন্য বড় পাওয়া। এ রায় দিতে পেরে আমি গর্বিত। আমি মনে করি, নারী জাতির জন্য এটি গর্বের বিষয়।’ এ সময় তিনি আইনজীবীদেরও কৃতজ্ঞতা জানান।

রায়ের প্রতিক্রিয়া
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও রিটকারী বদিউল আলম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, পুরো দেশবাসী এই রায়ে আনন্দিত। এই রায়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসার একটা গুরুত্বপূর্ণ দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। তবে এটা নির্ভর করবে ভবিষ্যতে কীভাবে আচরণ করা হয়। তিনি আরও বলেন, গণতন্ত্র ফিরে আসা, গণতান্ত্রিক উত্তরণ মানে একটা পরিবর্তন। সবাই যদি আচরণে পরিবর্তন আনে, রাজনীতিবিদরা যদি তাদের আচরণে পরিবর্তন আনেন, তাহলে গণতন্ত্র ফিরে আসবে।

রায়ের পর রিটকারীর আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া সুপ্রিম কোর্টে সাংবাদিকদের বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণ বাতিল চাইলেও হাইকোর্ট কিছু বিষয় বাতিল করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি ফিরে আসার ক্ষেত্রে বড় বাধা দূর হয়েছে। তবে সেটা এখনই ফিরছে না। কারণ, এ সংক্রান্ত রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। জানুয়ারিতে শুনানি হবে। সেটা আবেদনকারীদের পক্ষে নিষ্পত্তি হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সাবেক দুই প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছেন বলে মন্তব্য করে অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান বলেন, এ জন্য তাদের শাস্তি হওয়া দরকার। বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, হাইকোর্টের রায়ের ফলে সংবিধান ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন, সেখানে ফিরেছে।

আরও পড়ুন

×