ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

‘হর্ন বাজানো নিষেধ’ এলাকায় শব্দদূষণ কমেছে সামান্যই

‘হর্ন বাজানো নিষেধ’ এলাকায় শব্দদূষণ কমেছে সামান্যই

কোলাজ।

জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৫৬ | আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:৩৮

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও এর সামনে তিন কিলোমিটার মহাসড়ক ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করা হয়। ওই সড়কের বিভিন্ন স্থানে টাঙানো বোর্ডে লেখা, ‘হর্ন বাজানো নিষেধ’। উচ্চ শব্দ ঠেকাতে গেল কয়েক মাসে অভিযান ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া হলেও তা অনেকেই কানে তুলছেন না। 

তবে গবেষকরা এই নীরব এলাকায় শব্দের উপস্থিতি কিছুটা কমার প্রমাণ পেয়েছেন। নীরব এলাকা ঘোষণার আগের পাঁচ দিন, পরের পাঁচ দিন এবং ঘোষণার দুই মাস পরের পাঁচ দিনের নমুনা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলছেন, ২০০৬ সালের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, নীরব এলাকায় দিনের বেলায় শব্দের মাত্রা থাকবে ৫০ ডেসিবেল এবং রাতের বেলায় ৪০ ডেসিবেল। অথচ বিমানবন্দর এলাকার তিন কিলোমিটারের মধ্যে চার স্থানে কখনোই শব্দের মান মাত্রা ৫০-এর ঘরে নামেনি। তবে বেশির ভাগ এলাকায় আগের চেয়ে ০.৫৮ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ শব্দদূষণ কমলেও বিমানবন্দরের মূল প্রবেশপথে ০.৯৪ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল প্রবেশপথে ১.১৯ শতাংশ শব্দদূষণ বেড়েছে।

এ পরিস্থিতিতে শব্দদূষণ বন্ধে অভিযান নিয়মিত চলা দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে যত্রতত্র গাড়ির হর্ন বাজানো বন্ধে তাৎক্ষণিক (অন দ্য স্পট) মামলার ক্ষমতা চেয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এ নিয়ে গত ১৯ ডিসেম্বর ডিএমপি কমিশনার মো. সাজ্জাত আলী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে। ডিএমপির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশা করছেন, যত্রতত্র গাড়ির হর্ন বাজানোর বিরুদ্ধে শিগগির তারা মামলার ক্ষমতা পাবেন। তখন পরিস্থিতি কিছুটা বদলাবে। 

অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল প্রবেশপথ, বিমানবন্দরের মূল প্রবেশপথ, লা মেরিডিয়েন হোটেল ও স্কলাস্টিকা স্কুল পয়েন্টে শব্দের তীব্রতা নির্ণয় করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) ১০ সদস্যের গবেষক দল। গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। দলটি প্রথম ধাপে নীরব এলাকা কার্যকরের পাঁচ দিন আগে ২৬ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ও ১ থেকে ৫ অক্টোবর, দ্বিতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর এবং ২ থেকে ৫ ডিসেম্বর দিনের বিভিন্ন সময়ে শব্দের তীব্রতা নির্ণয় করে। স্বয়ংক্রিয় সাউন্ড লেভেল মিটারের মাধ্যমে প্রতিটি স্থানে দৈনিক ১৩ ঘণ্টার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। চার স্থানে ১৫ দিনে পাঁচ হাজার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

ক্যাপসের পর্যবেক্ষণ বলছে, নীরব এলাকা কার্যকরের আগের পাঁচ দিনের গড় শব্দমাত্রা ছিল ৮৭.৮১ ডেসিবেল। কার্যকরের পরবর্তী পাঁচ দিনে এটি কমে ৮৬.৪৯ ডেসিবেল হয়, অর্থাৎ ১.৩৩ ডেসিবেল (১.৫১ শতাংশ) শব্দদূষণ কমেছে। দুই মাস পর শব্দমাত্রা কার্যকরের আগের পাঁচ দিনের চেয়ে ০.৫১ ডেসিবেল (০.৫৮ শতাংশ) কমেছে। নীরব এলাকা কার্যকরের পরবর্তী পাঁচ দিনে লা মেরিডিয়েন হোটেলের সামনে ৬.০১ শতাংশ এবং স্কলাস্টিকা ক্যাম্পাসে ১.৮৫ শতাংশ শব্দদূষণ কমেছে। নীরব এলাকা কার্যকরের পরবর্তী পাঁচ দিনে বিমানবন্দরের মূল প্রবেশপথে ০.৯৪ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল প্রবেশপথে ১.১৯ শতাংশ শব্দদূষণ বেড়েছে। দুই মাস পর লা মেরিডিয়েন হোটেলের সামনে শব্দদূষণ ৪.৪৬ শতাংশ এবং স্কলাস্টিকা স্কুল পয়েন্টে ১.০৫ শতাংশ কম পাওয়া গেছে। তবে বিমানবন্দরের মূল প্রবেশপথে ০.৫৪ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল প্রবেশপথে ২.৯৭ শতাংশ শব্দদূষণ বেড়েছে। নীরব এলাকা কার্যকরের পর প্রথম দিনে লা মেরিডিয়েন হোটেলের শব্দমাত্রা ছিল ৮৯.৩৫ ডেসিবেল (আগের গড় ৯২.০৩ ডেসিবেল থেকে ২.৯১ শতাংশ কম)। স্কলাস্টিকা স্কুল পয়েন্টে শব্দমাত্রা ছিল ৮৪.৮৬ ডেসিবেল (আগের গড় ৮৬.৩২ ডেসিবেল থেকে ১.৬৯ শতাংশ কম)। দুই মাস পর লা মেরিডিয়েন হোটেলে শব্দমাত্রা ছিল ৮৪.৩৫ ডেসিবেল, যা কার্যকরের আগের গড় থেকে ৮.৩৪ শতাংশ কম। দুই মাস পর স্কলাস্টিকা স্কুল পয়েন্টে শব্দমাত্রা ছিল ৮৫.০৮ ডেসিবেল, যা কার্যকরের আগের গড় শব্দমান থেকে ১.৪৩ শতাংশ কম। নীরব এলাকা কার্যকর ঘোষণার পর প্রথম পাঁচ দিনে শব্দমাত্রা ১.৫ শতাংশ কমলেও দুই মাস পর এটি কার্যকরের আগের তুলনায় মাত্র ০.৫৮ শতাংশ কমেছে। সামগ্রিকভাবে কার্যকরের পর প্রথম ধাপে শব্দদূষণ কমলেও দ্বিতীয় ধাপে প্রথম ধাপের চেয়ে প্রায় ১ শতাংশ বেড়ে গেছে।

বিমানবন্দরের তিন কিলোমিটার এলাকাকে গত ১ অক্টোবর থেকে শব্দদূষণমুক্ত নীরব এলাকা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। হর্নের শব্দদূষণ ঠেকাতে চালকদের মাইকিং, প্রচারপত্র দিয়ে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হয়। এর পরের কয়েক দিন চলে অভিযান ও শাস্তি। এ জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), পরিবেশ অধিদপ্তর, সড়ক বিভাগ, পুলিশ, পরিবহন মালিক সমিতিকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। কিন্তু এখন অভিযান কমে গেছে।

গতকাল সোমবার বিমানবন্দর সড়ক ঘুরে সব ধরনের যানবাহনকে অহেতুক হর্ন দিতে দেখা গেছে। বিমানবন্দরের নির্মাণাধীন তৃতীয় টার্মিনালের ঠিক সামনের রাস্তার মাঝে ‘নীরব এলাকা’ সাইনবোর্ড লেখা রয়েছে; তবে চালকরা হর্ন বাজিয়ে ছুটে চলছেন গন্তব্যে। বিমানবন্দরের ভেতরে নীরব এলাকার নতুন সাইনবোর্ড দেখা গেলেও গাড়িচালকদের মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়নি। আগের মতোই হর্ন বাজিয়েই যাচ্ছেন তারা। নীরব এলাকা বাস্তবায়নে সরেজমিন কোনো কর্তৃপক্ষকেই পাওয়া যায়নি। 

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম দাবি করেছেন, সামনের অংশে নীরব এলাকা কার্যকর না হলেও বিমানবন্দরের ভেতরের অংশে শব্দদূষণ কিছুটা কমেছে।

ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, চালক ও যাত্রীরা নীরব এলাকার বিষয়ে এখনও অবগত নন। এয়ারপোর্টে বাসস্ট্যান্ডের কারণে শব্দদূষণ হচ্ছে। এয়ারপোর্টের মূল গেটের সামনে ইউটার্নের কারণে সৃষ্ট যানজটে শব্দদূষণ বেশি হয়। বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, রাস্তা সবুজ রং করা যেতে পারে, তার ওপর লেখা থাকবে নীরব এলাকা। হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি বন্ধ করা, হর্ন বাজানোর শাস্তি বাড়ানো ও চালকদের শব্দ সচেতনতা যাচাই করে লাইসেন্স দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর ওপর জোর দেন এই গবেষক।

ডিএমপি কমিশনার মো. সাজ্জাত আলী বলেন, যত্রতত্র গাড়ির হর্ন বা সাইরেন বাজানোর বিরুদ্ধে অন দ্য স্পট মামলা করার এখতিয়ার পুলিশের নেই। আমরা শব্দদূষণের জন্য দায়ী যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলার ক্ষমতাসহ একটি বিধি প্রণয়নের জন্য লিখিত প্রস্তাব দিয়েছি।

এ বিষয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, শব্দদূষণ আইন আমরা চূড়ান্ত করার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে জনসচেতনতা ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিতের ব্যবস্থা নেব। এখানে আমরা পুলিশকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখতে চাই।

আরও পড়ুন

×