বিআইডব্লিউটিএ নেতা মাজহারের ‘লম্বা হাত’
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়েও সম্পদের পাহাড়

মাজহারুল ইসলাম
অমরেশ রায়
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৪০ | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:২৮
এক মাজহারুল ইসলামের দাদাগিরিতে তটস্থ হয়ে পড়েছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সংস্থার সিবিএর কথিত এই ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সবাইকে রীতিমতো দৌড়ের ওপর রেখেছেন। নিজ সংগঠনের নেতাসহ প্রতিপক্ষকে মারধর ও মামলায় ফাঁসিয়ে কারাগারে পাঠানোসহ চালিয়ে যাচ্ছেন নানাভাবে হয়রানি। শুধু তাই নয়, ‘সহকারী’ পদের তৃতীয় শ্রেণির এই কর্মচারী অল্পদিনেই উঠেছেন সম্পদের চূড়ায়।
এর আগে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার দিনই মাজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে বিএনপি-সমর্থিত কর্মচারীরা রাজধানীর মতিঝিলের বিআইডব্লিউটিএ ভবনে হামলা চালান। পরে তালা ভেঙে ভবনের নিচতলার বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন (রেজি. নম্বর-২১৭৬) সিবিএ কার্যালয় দখল করে নেন। মাজহার নিজেকে বিআইডব্লিউটি এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন এবং সিবিএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে ঘোষণা দেন। এক পর্যায়ে বিআইডব্লিউটিএর প্রভাবশালী কয়েকজন কর্মকর্তার সহযোগিতায় মাজহার ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন। এর পর থেকেই তাঁর দাপটে অসহায় সাধারণ কর্মচারীরা।
বিআইডব্লিউটিএ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সভাপতি দাবি করেন মাজহার। এক্ষেত্রে ২০২২ সালে অনুমোদিত বিআইডব্লিউটিএ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের একটি কমিটি সামনে আনা হয়। অথচ ২০১৫ সাল থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত দুই দফায় বিআইডব্লিউটিএ জাতীয় শ্রমিক লীগের ১ নম্বর সহসভাপতি ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে টাঙ্গাইল-২ আসনের তৎকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ছোট মনির বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে মাজহারকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ও আওয়ামী পরিবারের সন্তান’ উল্লেখ করে তাঁকে সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে বদলির সুপারিশ করেন।
এদিকে সিবিএর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব কুমার দাস শ্রম আদালতে মামলা করে নিজের বদলি স্থগিতসহ মাজহারের শাস্তি দাবি করে শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে গত ১২ সেপ্টেম্বর লিখিত অভিযোগ দেন। গত ৬ নভেম্বর বিআইডব্লিউটি এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান ক্ষমতার অপপ্রয়োগসহ সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে মাজহারকে ইউনিয়নের ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি দেন। এর পরও ইউনিয়ন ও সিবিএ কার্যালয় নিজের দখলে রেখে বদলি ও কমিটি বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন মাজহার।
কর্মচারীরা জানান, বদলি ও পুনঃবদলি করিয়ে মাজহার নতুন করে হয়রানি না করার কথা বলে ‘আওয়ামী লীগ সমর্থক’ সিবিএ নেতা ও সাধারণ কর্মচারীর কাছ থেকেও টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। অভিযোগ আছে, সিবিএর তিন নেতার কাছ থেকেই ৭০ লাখ টাকা নিয়েছেন। এর পরও উল্টো তাদের হয়রানি করার পাঁয়তারা চালাচ্ছেন।
প্রতিপক্ষকে ফাঁসান মামলায়
বিআইডব্লিউটি এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আজিজুল হককে নিয়ে ১১ নভেম্বর এসেছিলেন সংস্থার কার্যালয়ে। সেখানে তাদের ওপর চড়াও হন মাজহার ও তাঁর সঙ্গীরা। পরে মজিবুর ও আজিজুলকে মারতে মারতে মতিঝিল থানায় নেওয়া হয়। এ বিষয়ক ভিডিওচিত্র সমকালের হাতে এসেছে।
আজিজুল হক সমকালকে জানান, ওইদিন গভীর রাত পর্যন্ত থানায় বসিয়ে রেখে মজিবুরের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে পরদিন কারাগারে পাঠান মাজহার। তিনি (আজিজুল) অবশ্য থানার মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত ও হাসপাতালে ভর্তি হয়ে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান। তবে ১০ ডিসেম্বর সংস্থার কার্যালয়ে গেলে মাজহার আবারও তাঁর ওপর হামলা চালান।
এদিকে, মাজহারুল ইসলামের মামলায় গ্রেপ্তার মজিবুর রহমান গত মঙ্গলবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
একই মামলায় আসামি করা হয়েছে সিবিএর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব কুমার দাসকেও। অথচ ওই ঘটনার সময় সঞ্জীব নিজেই অসুস্থ হয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সঞ্জীব বলেন, ‘আমি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে ঢাকার ঘটনায় আমার নামে মিথ্যা মামলা করেন মাজহার। আমরা এ হয়রানির প্রতিকারসহ অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ এবং বৈধ কমিটির কাছে সিবিএ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বিআইডব্লিউটিএ ও নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি।’
এদিকে সিবিএর সাবেক সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ও তাঁর ছেলে সম্প্রতি সংস্থার কার্যালয়ে গেলে তাদেরও মারধর করেন মাজহার। পরে রফিকুল ইসলাম সিএমএম আদালতে মামলা করেন, যা পিবিআই তদন্ত করছে।
আওয়ামী লীগ আমলেও ছিল দাপট
নিজেকে শ্রমিক দলের নেতা দাবি করলেও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও বেশ দাপটে চলেছেন মাজহার। সে সময় শ্রমিক লীগ ও বিআইডব্লিউটিএ সিবিএর নেতা পরিচয় দিয়ে নানা অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা বাগিয়েছেন তিনি। ২০১৩ সালে চাঁদপুরে কর্মরত থাকাকালে এক কর্মচারীর স্ত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ান। তবে প্রভাব খাটিয়ে সে সময় ওই ঘটনা ধামাচাপাও দেন।
আওয়ামী লীগ আমলে আপন দুই ভাইকে বিআইডব্লিউটিএতে চাকরি পাইয়ে দেন মাজহার। তাঁর এক ভাই জাহিদুল ইসলাম তৃতীয় শ্রেণির ‘ষাট মুদ্রাক্ষরিক’ পদে নিয়োগ পেলেও গত পাঁচ বছর বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের পরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার পদ দখলে রেখেছেন। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়েও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তার পদ দখলে রাখার পেছনে ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়েছেন জাহিদ। এক মেয়াদে সিবিএর সহসভাপতিও ছিলেন তিনি। মাজহারের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে তাঁর গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের বিলচাপড়া গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন।
এর আগে আওয়ামী লীগ আমলেই ঢাকার সাভারে তিনতলা বাড়িও করেছেন তৃতীয় শ্রেণির এই কর্মচারী। অবৈধভাবে কামানো টাকা আড়াল করতে ওই বাড়িটি শ্বশুরের নাম জুড়ে দিয়েছেন।
যা বলছেন মাজাহার
মাজহারুল ইসলাম তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি ২০১৫ সাল থেকে শ্রমিক দল করি। ২০১৬ সালে এই সংগঠনের পদে এসেছি। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শ্রমিক লীগের পদ দেওয়া হলে সেটা জানামাত্রই লিখিতভাবে অব্যাহতি নিয়েছি।
তিনি বলেন, হাইকোর্টের রায়েই বিআইডব্লিউটিএ সিবিএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। তবে শিগগিরই সিবিএর নির্বাচন দেবেন। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।
মাজহার বলেন, মজিবুর রহমানকে আমি কারাগারে পাঠাইনি। অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনি। তবে মজিবুর ও আজিজুল সংস্থার কার্যালয়ে তাদের ইউনিয়নের ব্যানার খুলে নিতে এলে থানায় একটি জিডি করেছিলাম। তাদের মারধরও করিনি। এ ছাড়া সঞ্জীব কিছু কর্মকর্তাকে ব্লাকমেইলিং করে তাঁর (মাজহার) নামে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মিথ্যা রিপোর্ট করাচ্ছেন। এ কারণেই সঞ্জীবের বিরুদ্ধে মামলা করেছি।
কর্মচারী বদলি ও বদলি স্থগিত বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অর্থ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন যারা একই পদে আছেন, এমন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করেছে কর্তৃপক্ষ। এতে আমার সম্পর্ক নেই। সাভারের বাড়ি তাঁর শ্বশুর নিজের টাকায় করেছেন বলেও দাবি করেন মাজহার।
- বিষয় :
- দুর্নীতি
- বিআইডব্লিউটিএ