স্বাধীন মতপ্রকাশ ও কণ্ঠরোধের শঙ্কা

কোলাজ
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:৪৫ | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৮:০৬
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সচিবালয়ে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে সরকার। বাতিল করা হয়েছে সাংবাদিকদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে গতকাল শনিবার সরকার এ সিদ্ধান্তকে সাময়িক বলে জানিয়েছে। বলেছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রতিদিন অস্থায়ী পাস ইস্যু করবে।
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ‘হটকারী’ আখ্যা দিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, সরকারের এমন অবস্থান স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অতীতের সরকারগুলো আইনকানুনের মাধ্যমে যেভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ করত, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও সে পথে এগোচ্ছে।
গত বুধবার রাতে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে ভয়াবহ আগুন লাগে। ভবনের চারটি তলায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, সড়ক পরিবহন ও সেতু, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নথিপত্র, কম্পিউটার ও আসবাব ছাই হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সাংবাদিকদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ইস্যু করে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন তথ্য অধিদপ্তর (পিআইডি)। কিন্তু নিয়মের বাইরে গিয়ে কার্ড বাতিল করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তারা তথ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা পর্যন্ত করেনি বলে জানা গেছে।
অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত নভেম্বরে তিন দফায় ১৬৭ সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করে। নতুন করে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিলের ঘটনায় সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) একাংশের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য হুমকিস্বরূপ। এটি স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশ শুধু বাধাগ্রস্ত করবে না, সংবাদমাধ্যমের অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকেও হুমকিতে ফেলবে।
পরে আকতার হোসেন সমকালকে বলেন, অবৈধ কার্ডধারী থাকলে তদন্ত করে, সেটি বাদ দেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন কার্ড বাতিলের সিদ্ধান্ত এক ধরনের দ্বিচারিতা।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামও (ইআরএফ) বিবৃতিতে সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করেছে।
বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুল হক বলেছেন, রোববার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমরা সচিবালয়ে সাংবাদিকদের নির্বিঘ্নে কাজ করা পরিবেশ দাবি করব।
গতকাল দুই সন্তান নিয়ে সচিবালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা আবু তৈয়ব হাবিলদার। তিনি দাবি করেন, অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত না করে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা অশুভ ইঙ্গিত দেয়।
মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলেছেন, সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিলের সিদ্ধান্ত মানুষের মধ্যে অনাস্থা তৈরি হতে পারে, যা স্বাধীন মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে।
ওভারসিজ করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ওকাব) সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিলে তুলে ধরা সরকারের যুক্তি খুবই খোঁড়া। এ সিদ্ধান্তে স্বাধীন সাংবাদিকতা ব্যাহত হবে। সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করলে দ্রুত সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করবে।
এ ব্যাপারে প্রধান তথ্য কর্মকর্তা নিজামূল কবীরের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল।
জানা যায়, দিন সাত থেকে সাড়ে সাত হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজের কার্ড পাঞ্চ করে সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দর্শনার্থী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সভা, সৌজন্য সাক্ষাৎ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন বেসরকারি ব্যক্তিদের জন্য ইস্যু করা অস্থায়ী পাস দেখিয়ে দিনে আরও এক থেকে দেড় হাজার মানুষ সচিবালয়ে প্রবেশ করেন।
সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত জুনে দিনে গড়ে ১৮ থেকে ২০ হাজার মানুষ সচিবালয়ে ঢুকতেন। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রবেশকারীর বেশির ভাগই আসতেন নানা তদবিরে। সচিবালয় নিরাপত্তা শাখা জানায়, প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ দিনে সর্বোচ্চ ২০টি পাস ইস্যু করতে পারে।
সাংবাদিকদের জন্য দুই ধরনের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ইস্যু করে পিআইডি। বর্তমানে এক বছরের অস্থায়ী এবং তিন বছরের স্থায়ী কার্ড ইস্যু রয়েছে প্রায় চার হাজার।
আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে শত শত কার্ড
গতকাল প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সেক্রেটারি আহম্মদ ফয়েজ ফেসবুকে লিখেছেন, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর হাতে শত শত অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড রয়েছে। সে কারণে সচিবালয়ে প্রবেশে সাময়িক সময়ের জন্য অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড স্থগিত করা হয়েছে। তিনি আরও লিখেছেন, পতিত আওয়ামী লীগ পেশাদার সাংবাদিকদের কার্ড না দিয়ে এবং বাতিল করে হয়রানি করলেও বিভিন্ন ভুয়া নিউজ পোর্টাল ও পত্রিকার নামে তাদের নেতাকর্মীকে শত শত কার্ড ইস্যু করেছে।
নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সচিবালয়ে প্রবেশের জন্য ইস্যু করা কয়েকশ অস্থায়ী কার্ড সম্প্রতি বাতিল করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং বিভিন্ন ঠিকাদারদের নামে এসব কার্ড ইস্যু করা হয়েছিল।
অস্পষ্ট বিজ্ঞপ্তির নানা ব্যাখ্যা
শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বেসরকারি ব্যক্তিদের জন্য অস্থায়ী পাস ও সাংবাদিকদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়। এতে বলা হয়, বাতিল করা বিভিন্ন ক্যাটেগরির কার্ডধারীরা আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ডিএমপির ক্রাইম কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের বিশেষ সেলে নতুন করে অস্থায়ী প্রবেশ পাসের জন্য আবেদন করতে পারবেন। একজন সিনিয়র সহকারী সচিবের নেতৃত্বে দুই কর্মকর্তা এ সেলে দায়িত্ব পালন করবেন।
তবে এ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এর পর শনিবার আরেক বিজ্ঞপ্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, সচিবালয়ে আগুনের ঘটনায় তদন্ত চলমান থাকার পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারের বিষয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত সাময়িক। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সভা করে দ্রুত এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ ছাড়া গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন, নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশ সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকার শিগগির বিদ্যমান কার্ডগুলো পর্যালোচনা করবে এবং নতুন করে প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেবে। সচিবালয়ের দৈনন্দিন ঘটনাবলির সংবাদ সংগ্রহে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অস্থায়ী দৈনিক পাস কার্ড দেবে।
- বিষয় :
- স্বাধীনতা
- মতপ্রকাশের স্বাধীনতা