ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকার : ড. বদিউল আলম মজুমদার

মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধের উপায় পাচ্ছে না কমিশন

মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধের  উপায় পাচ্ছে না কমিশন

ড. বদিউল আলম মজুমদার

 মসিউর রহমান খান

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:১১

দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা কলুষিত হওয়ার পেছনে মনোনয়ন বাণিজ্যকে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংস্কারে গঠিত কমিশন। তবে মনোনয়ন বাণিজ্যের সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় তারা বের করতে পারেনি। আগামী সপ্তাহে খসড়া প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিলেও এ বিষয়ে তারা কোনো সুপারিশ করছেন না বলে জানিয়েছেন কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার।

গতকাল রোববার সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেলে সংস্কার কমিশনের অস্থায়ী কার্যালয়ে সমকালের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। 
দীর্ঘদিন নির্বাচনী ব্যবস্থার উন্নয়ন ও যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রে সোচ্চার থাকা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বদিউল আলম মজুমদারের মতে, মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণেই প্রার্থীরা নির্বাচনে জয়ী হয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জনে এক ধরনের ‘অনৈতিক বৈধতা’ লাভ করেন। ফলে তারা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়মে অংশ নেন; স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রভাবিত করেন। এমনকি একজন কর্মকর্তা সারাজীবন চাকরি করে যে টাকা পাবেন, তার চেয়ে বেশি টাকা একজন প্রার্থী তাঁকে দিয়ে দিচ্ছেন। ফলে তিনি সব ধরনের নীতিনৈতিকতা ও আইনকানুন ভুলে ওই প্রার্থীর পক্ষে কারচুপিতে অংশ নেন। এটা অনেকটা প্রকাশ্যে ঘটলেও প্রতিরোধে কেউ এগিয়ে আসেন না।

তিনি জানান, এ থেকে উত্তরণের উপায় তারা হন্যে হয়ে খুঁজছেন। এটি বন্ধ না হলে সবই হবে পণ্ডশ্রম। তবে এর কোনো প্রতিকার সংস্কার কমিশন খুঁজে পায়নি বলেও মন্তব্য করেন কমিশনপ্রধান। 
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বিগত তিন (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সাল) নির্বাচনে যেভাবে অন্যায় হয়েছে, তা নজিরবিহীন। এ নিয়ে সংস্কার কমিশন ওই সব নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পুলিশের দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছে। সেখানে যা পাওয়া গেছে তাতে এককথায় বলা যায়, কেষ্ট ব্যাটাই চোর। কেউ বলেছেন, বাধ্য করেছেন; কেউ আবার অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছেন। এই তিন নির্বাচন যাতে মূল্যায়ন করে বর্তমান কমিশন শিক্ষা নেয়, সে সুপারিশ তাদের প্রস্তাবে থাকবে বলেও জানান তিনি।

চারটি পর্যায়ে সুপারিশ থাকবে জানিয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল ও জনগণের কাছেও কিছু সুপারিশ করবে এই সংস্কার কমিশন।
সংস্কার কমিশন এখন কী কাজ করছে– এমন প্রশ্নের জবাবে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সব (প্রস্তাব) ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে; এখন একত্র করার কাজ চলছে। তিনি জানান, সব উপাদান তৈরি। এখন রান্নার আগের কাজটি সম্পন্ন হচ্ছে। খাওয়ার (বাস্তবায়ন) বিষয়টি অবশ্য আরও পরের ব্যাপার।

আগামী সপ্তাহেই সরকারের কাছে খসড়া সুপারিশ জমা দেওয়ার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, সব কমিশনই খসড়া প্রস্তাব জমা দেবে। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন প্রস্তাব একটা জমা দেওয়া হয়েছে। সুপারিশ জমা দেওয়ার পর এগুলো আরও পরিশীলিত করার সুযোগ থাকবে।
তিনি জানান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ভোটার তালিকা আইন, সীমানা নির্ধারণ আইনসহ নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সব আইনই পর্যালোচনা করা হয়েছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের জন্য বিদ্যমান আরপিও প্রযোজ্য হবে না। তবে এ প্রস্তাব দেবে সংবিধান সংস্কার কমিশন। 

ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, আগামী সংসদ নির্বাচন বিদ্যমান আরপিওতে হবে। কারণ, এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের জন্য বিদ্যমান আরপিও আবারও পরিবর্তন করতে হবে। কারণ, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি; এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে। 

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বেশ কিছু বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন ছাড়াও এর মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ বেঁধে দেওয়াসহ কিছু বিষয়। ভোটের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাবের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি সহজ বিষয় নয়। এ বিষয়ে ব্যাপক মতদ্বৈধতা বা নানা মত রয়েছে। তবে এ প্রস্তাব ফেলে দেওয়া হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো কিছুই পুরোপুরি পরিশুদ্ধ নয়। এটির অনেক সমস্যা ও সমালোচনা রয়েছে। গুরুতর সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। বিশ্বের বহু দেশে আনুপাতিক এবং সরাসরি এমন মিশ্রণ পদ্ধতিও রয়েছে। এ বিষয়ে প্রস্তাবের দায়িত্ব সংবিধান সংস্কার কমিশনের বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে কমিশনপ্রধান বলেন, এ ইস্যুতে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আবারও বসার কথা রয়েছে। দ্বিকক্ষ সংসদ হলে উচ্চ কক্ষে আংশিক আনুপাতিকের প্রস্তাব হতে পারে। তবে এ নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না। 

আগামী সংসদ নির্বাচন বিদ্যমান এক কক্ষ সংসদ বসতে যাচ্ছে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনজ্ঞদের মতে, নির্বাচিত সংসদ ছাড়া এ মুহূর্তে সংবিধান সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই। বিদ্যমান পদ্ধতিতে গণপরিষদ নির্বাচিত করার সুযোগ আছে বলেও তিনি মনে করেন না। তাহলে সংবিধান বাতিল করতে হবে এবং নতুন সংবিধানের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন হতে হবে। গণপরিষদের কত আসন হবে, কীভাবে ভোট হবে তা-ও আবার নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

রাজনৈতিক দলের জন্য নতুন আইন প্রণয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি জিয়াউর রহমানের আমলে হয়েছিল; কিন্তু কার্যকর হয়নি। জার্মানিসহ অনেক দেশে রাজনৈতিক দল তৈরির বিধানাবলি সংবিধানেই উল্লেখ রয়েছে। এ বিষয়েও আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা তিনি জানেন না। 

কমিশনপ্রধান বলেন, ১/১১ সরকারের আমলে সংশোধিত আরপিওতে দলীয় মনোনয়নের জন্য তৃণমূল থেকে মনোনীত প্যানেলের মাধ্যমে প্রার্থীদের মনোনয়নের বিধান চালু করা হয়েছিল। সেটি মানা হলেও ৫ আগস্টের মতো মর্মান্তিক পরিণতি হয়তো নাও ঘটতে পারত। সেই বিধানও পরে বাতিল করা হয়। লেজুড়বৃত্তি বন্ধে ছাত্র সংগঠনকে সহযোগী সংগঠন না করার বিধান করা হলেও রাজনৈতিক দলগুলো ভ্রাতৃপ্রতিম নাম দিয়ে এগুলো চালু রাখল। যার পরিণতি ছাত্রলীগ সরকারের পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হলো। ১/১১-এর এসব সংস্কার মেনে চললে ছাত্রলীগের এই দানবীয় রূপ হয়তো দেখতে হতো না।
তবে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইন সংশোধনে কিছু সুপারিশ থাকছে জানিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের বিদেশি শাখা এবং সহযোগী সংগঠনকে ভ্রাতৃপ্রতিম বানিয়ে চালানোর সুযোগ বন্ধের সুপারিশ থাকবে। মনোনয়নের ক্ষেত্রে আবারও দলের তৃণমূলের কাছ থেকে মনোনয়ন প্যানেল রাখার বিধান পুনরায় ফিরিয়ে আনার চিন্তা করা হচ্ছে। 

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের বিধান তুলে দেওয়ার বিষয়টি এক ধরনের নিশ্চিত সিদ্ধান্ত– এমন মন্তব্য করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, স্থানীয় সরকারের সবকটি স্তরের নির্বাচনও নির্দলীয় সরকারের অধীনে আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে বা কাছাকাছি সময়ে স্থানীয় সরকার আয়োজনের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে সংস্কার কমিশনের। স্থানীয় সরকারের স্তর ভেঙে নতুন কোনো কাঠামো তৈরি বা পুনর্বিন্যাসের বিষয়টি স্থানীয় সরকার কমিশনের সুপারিশে থাকবে। এই কমিশনের প্রধান ড. তোফায়েল আহমেদ অবশ্য নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। 

নিষিদ্ধ না হলে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা কোথায়– এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি সংস্কার কমিশনের এখতিয়ারে পড়ে না। এটি নির্বাচন কমিশনের বিষয়।

জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের নেতৃত্বে থাকা ছাত্রনেতারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করছে বলে অভিযোগ উঠছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব দল নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাবে কি পাবে না, এ সিদ্ধান্ত সংস্কার কমিশনের নয়। এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। 

আগামী সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে, নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৩১ ডিসেম্বর ছাত্রনেতারা কী ঘোষণা দেন, তার ওপরে এসব বিষয় বহুলাংশে নির্ভর করছে। যদিও তিনি জানেন না, ছাত্ররা কী ঘোষণা দেবেন। যদি কোনো পরিবর্তন হয়, তাতে সমস্যা হবে না। কারণ, এই প্রস্তাব মাত্র খসড়া। 

নতুন ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর এবং প্রার্থী হওয়ার বয়স ২১ বছর করার প্রস্তাব নিয়ে কমিশনের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা মাত্র শুরু হয়েছে। এর আগে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। তবে এ বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব আসতে হবে, কারণ এটি তাদের এখতিয়ারে। 
নির্বাচনী অনিয়মের বিচারে দীর্ঘসূত্রতার ক্ষেত্রে কমিশনের সুপারিশ থাকছে জানিয়ে তিনি বলেন, আদালতকে তো আর বাধ্য করার সুযোগ নেই। তবে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সঙ্গে তাদের আলাপ-আলোচনা চলছে।

 

আরও পড়ুন

×