গ্যাসের দাম দ্বিগুণ হলে শিল্প থাকবে না

.
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০১:১৯
গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব কার্যকর হলে দেশে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকবে না। নতুন করে কোনো শিল্প গড়ে উঠবে না। গতকাল রোববার পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত সেমিনারে উদ্যোক্তারা এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ‘জ্বালানি সহজলভ্যতায় নীতি এবং শিল্প প্রতিযোগিতায় এর প্রভাব’ শীর্ষক সেমিনার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত হয়।
গত ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় পেট্রোবাংলা। এতে শিল্পে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়। তবে পুরোনোদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়। দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আমলে নিয়ে আগামী বুধবার শুনানি ডেকেছে বিইআরসি।
শিল্পকারখানায় দুই ধরনের গ্যাসসংযোগ দেওয়া হয়। কারখানার বয়লার চালাতে এবং বড় কারখানায় নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ক্যাপটিভ সংযোগ। দুটি সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম এখন একই। পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পুরোনো গ্রাহকের ক্ষেত্রে অনুমোদিত লোডের বাড়তি ব্যবহৃত গ্যাসের বিল হবে নতুন দামে।
যেসব শিল্পকারখানা নতুন সংযোগের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত আগের দাম দিতে হবে। বাকিটুকুর জন্য নতুন দাম প্রস্তাব করা হয়েছে।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, বুধবার শুনানি থাকায় এ বিষয়ে তার বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে তারা যেন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সে জন্য সব পক্ষের কথা শুনছেন।
বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, সরকার নতুন শিল্পের জন্য ১৫০ শতাংশ এবং বিদ্যমান শিল্পের সম্প্রসারণের জন্য ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। সরকারের এমন পরিকল্পনা থাকলে আমরা কেউ শিল্প করতে চাই না।’ তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শিল্পের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। ব্যাংকে সুদের হার বেশি। এনবিআরেও সমস্যা আছে। এ অবস্থায় অযৌক্তিকভাবে গ্যাসের দাম বাড়ালে উদ্যোক্তারা কেউ নতুন বিনিয়োগ করবে না।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে কমানোর উপায় নিয়ে গবেষণা করা দরকার। কমিশন খাওয়ার জন্য স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কিনতে অস্থির ছিল গত সরকারের লোকজন। তারা বিদেশে বসে এখনও কমিশন খাচ্ছে। উদ্যোক্তারা মূলত ফেঁসে গেছেন। গ্যাসের দাম বাড়ানো দূরে থাক, কমানো না গেলে শিল্প থাকবে না।
বিটিএমএ সভাপতি আরও বলেন, কিছু ব্যাংককে টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ ব্যাংকগুলো লুট হয়েছে। ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে টাকা দেওয়া হলেও শিল্প টিকিয়ে রাখার দিকে মনোযোগ নেই। ব্যাংক ঋণের সুদহার এখন ১৮ শতাংশ।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার ১১ টাকা ৫৮ পয়সার গ্যাস বাড়িয়ে ৩০ টাকা করে। ওই সময় শিল্পে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানো হয়। তবে দাম বাড়ানোর পর থেকেই গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা খারাপ হয়। পরে যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। ২০২২ সালের আগে যে শিল্প ইউনিটে গ্যাস বিল ২ কোটি ১০ লাখ টাকা ছিল, দাম বাড়ানোর পর তা ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা হয়। প্রস্তাবিত দাম কার্যকর হলে বেড়ে হবে ১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে কারখানা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। তিনি সরকারকে এ বিষয়ে আরও সময় চাওয়ার অনুরোধ জানান। প্রায় একই কথা বলেন ‘ইউরোচ্যাম’-এর প্রেসিডেন্ট নূরিয়া লোপেজ। তিনি বলেন, শুধু রাজনীতিবিদ ও আমলারা প্রস্তুত বললেও বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পর্যায়ে নেই।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য বিদেশি উদ্যোক্তা মরিয়া হয়ে নেই। অনেক বিনিয়োগ গন্তব্যের বাংলাদেশ একটি– এটি খেয়াল রাখতে হবে। তাঁর মতে, বাংলাদেশে জ্বালানির ব্যবস্থাপনা ভালো নয়। একই সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি দেশি বিদেশি উভয় বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ কখনোই জ্বালানি সংকটের বাইরে ছিল না।
তবে বর্তমানে দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে। গত ২০১৫-১৬ বছরের দিকে দেশে ২ হাজার ৮০০ এমএফসিএফ গ্যাস উৎপাদন হলেও বর্তমানে তা এক হাজার ৯০০ এমএফসিএফে নেমে এসেছে।
সেমিনার মূল প্রবন্ধে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, এখনকার চ্যালেঞ্জিং সময়ে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করা হলে উৎপাদনমুখী খাতে পণ্য উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে। কমবে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। নতুন বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সিমেন্ট, ইস্পাত ও সিরামিক খাতে নতুন করে আমদানিনির্ভরতা বাড়বে। ফলে আর্থিক খাতে চাপ পড়বে।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন বিএসআরএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলী হোসাইন, ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওন প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য দেন ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালা।
- বিষয় :
- গ্যাসের দাম