প্রয়াণ দিবসে স্মরণ
সত্যজিৎ রায়ের মানসপট

সত্যজিৎ রায়। ফাইল ছবি
বিধান রিবেরু
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২৫ | ০১:১২ | আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫ | ০৬:৪৯
সত্যজিৎ রায় এমন একজন পরিচালক, যিনি মানবসভ্যতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। সমাজের ভেতর জ্ঞান-বিজ্ঞান-বিশ্বাস-অর্থনীতি ইত্যাদির দ্বারা মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক নির্ধারিত হয়, মিথস্ক্রিয়া হয়, সেটাই মানবসভ্যতা। সভ্যের বিপরীত অসভ্য শব্দটার দিকে তাকালেই মানবসভ্যতা বলতে আসলে কী বোঝায়, তা আন্দাজ করা যায়। এটিকেই ধারণা হিসেবে মানসপটে রেখে সৃজনশীল কাজ করে গেছেন সত্যজিৎ রায়।
‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিটিকে অনেকে হয়তো রূপকধর্মী রাজনৈতিক ছবি বলবেন। আমি বলব, ছবিটি শেষ পর্যন্ত মানবসভ্যতার পক্ষে কথা বলে, যেখানে শোষণ ও বঞ্চনা থাকবে না। অন্যদিকে, এটি যন্ত্রসভ্যতার সমালোচনাও করে। যন্তরমন্তর ঘরে বসানো যন্ত্রটি মগজ ধোলাই করে সাধারণ মানুষের, যা সভ্যতার পরিপন্থি।
‘আগন্তুক’ ছবির সেই দৃশ্যটি নিশ্চয় সকলে দেখেছেন, যেখানে উৎপল দত্তকে বেকায়দায় ফেলার জন্য বলা হচ্ছে, বিজ্ঞান এত উন্নত হয়ে যাচ্ছে আর আপনি কিনা বন্য সভ্যতা, ক্যানিবালিজম ইত্যাদিকে সমর্থন করছেন? তখন উৎপল দত্ত বলেছিলেন, ‘সভ্য কী বলব? বর্বর সভ্য হচ্ছে সেই মানুষ, যে আঙুলের একটা চাপে একটা বোতাম টিপে একটা ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে একটা গোটা শহরকে সমস্ত অধিবাসীসমেত ধ্বংস করে দিতে পারে।’
অর্থাৎ সত্যজিতের মনোজগতে সভ্যতার যে আকাঙ্ক্ষিত রূপ, তার সঙ্গে মানুষের এমন বর্বর আচরণ মিলছে না। কিন্তু তালাশ করে দেখা যেতে পারে, মানুষের ইতিহাস কখনও আদর্শিক জায়গা থেকে সভ্য ছিল কিনা। মানে, মানুষ কি কখনও হানাহানি, মারামারি ও খুনোখুনি ছাড়া ছিল? ছিল না। তাহলে যে সভ্যতার কথা আমরা বলি, সেটি একটি ধারণা মাত্র।
আগন্তুকের মতো স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘টু’-তেও একই বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন সত্যজিৎ। নির্বাক ছবিটি শিশুতোষ হলেও রূপকাশ্রয়ী গল্পটির লক্ষ্য কিন্তু বড়রা। সেখানে তিনি দেখালেন, দুর্বলের বিরুদ্ধে উন্নত প্রযুক্তি ও অস্ত্র ব্যবহার করে জয় পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তাতে পরাজিত হয় মানবসভ্যতা। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দিকে তাকালেও এটি বোঝা যায়।
প্রতিদ্বন্দ্বী, সীমাবদ্ধ ও জনঅরণ্যেও সত্যজিৎকে সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপন করতে দেখা যায় না। বরং শহরের বাস্তবতায় তিনি দেখিয়েছেন মানবসভ্যতার মুখ থুবড়ে পড়াকে। রাজনীতির নামে মানুষ মারা হচ্ছে, কেউ সামান্য চাকরির জন্য মানুষ মারতেও প্রস্তুত, কেউ বা নিজের বন্ধুর বোনকে বিক্রি করে দিচ্ছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের এই যে সম্পর্ক, সেটি মানবসভ্যতার ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সত্যজিৎ ওটাকেই বড় করে দেখাতে চেয়েছেন।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ১৯৯১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় সত্যজিৎ রায়কে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার জীবনে রাজনীতি কতটা প্রভাব ফেলেছে? সত্যজিৎ রায় জবাবে বলেছিলেন, ‘তা আমার জীবনে খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি বা খুব বেশি স্থান অধিকার করেনি। আমার ছবিতে মাঝেমধ্যে রাজনীতি এসে পড়ে। এ ক্ষেত্রে না এসে উপায়ও নেই, বিশেষ করে আজকের দিনে। কিন্তু কোনো চরিত্রকে আমি কখনও ব্যবহার করিনি, যাকে পলিটিশিয়ান বলা যায়। রাজনীতি আমার ছবিতে পরোক্ষভাবে এসে যায়।’
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো যেমন ভাবতেন, চোখের সামনে থাকা মানুষের বাইরে ‘মানুষ’ একটা ধারণা মানুষের মনে বিরাজ করে, সত্যজিৎ রায়ও আস্থা স্থাপন করেছিলেন অভিজ্ঞতার বাইরে থাকা মানবসভ্যতা ধারণার ওপর, উন্নত মানুষের ওপর। এ কারণেই তাঁর শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এ আমরা দেখি, উৎপল দত্ত ওরফে ‘মিস্টার নো-ওয়ান’ চরিত্রটির ওপর শেষ পর্যন্ত আস্থা রাখে ছোট পরিবারটি। নো-ওয়ান মানে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে চৈতন্যের ভেতর অস্তিত্বহীন মানুষটি সব নীতিনৈতিকতা ও রহস্যময়তা নিয়ে স্থান করে নিতে পারেন অনায়াসে, ঠিক মানবসভ্যতার ধারণাটি যেমন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র গবেষক
- বিষয় :
- স্মরণ