ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে ফাহমিদা খাতুন

অর্থনীতির প্রয়োজনে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা জরুরি

অর্থনীতি জটিল সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে

অর্থনীতির প্রয়োজনে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা জরুরি

ফাহমিদা খাতুন

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫ | ০১:০৩ | আপডেট: ২৮ মে ২০২৫ | ০৭:০০

অন্তর্বর্তী সরকারের ৯ মাস পার হওয়ার পর এখন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার সময় হয়েছে। ডিসেম্বর, জানুয়ারি বা মার্চ– যে মাসেই হোক; সরকারকে সুস্পষ্ট করা উচিত। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তায় দেশের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কর্মসংস্থান এবং প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার প্রেক্ষাপটে এমন মনে করছে গবেষণা সংস্থা সিপিডি। 

জাতীয় বাজেট ঘোষণার আগে গতকাল মঙ্গলবার ‘২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাংলাদেশের অর্থনীতি’ শীর্ষক তৃতীয় পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এমন মত দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ সময় সংস্থার সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেমসহ গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে। 

বিনিয়োগে গতি না এলে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তখন দারিদ্র্য ও বৈষম্য আরও বাড়বে। শুধু বিনিয়োগকারীরা নন; কেউই অস্থিতিশীলতা পছন্দ করে না।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকার গত কয়েক মাসে বিভিন্ন সংস্কারমূলক উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাজস্বনীতি এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আলাদা করা। পাশাপাশি শেয়ারবাজারের উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ আকর্ষণে সংস্কার উদ্যোগ রয়েছে। ব্যাংক খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এসব সংস্কার উদ্যোগের সাফল্য সীমিত। অনেক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার বাধার মুখে পড়ছে। খণ্ডিত পদক্ষেপের বাইরে গিয়ে বিস্তৃত সংস্কারের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকতে হবে। না হলে অনেক ক্ষেত্রে ফল বয়ে আনে না। শুধু দৃশ্যমান এবং সাহসী সংস্কার টেকসই অর্থনীতি, বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনেকেই নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা বলছেন। অন্তর্বর্তী সরকার বারবারই বলছে– ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এখানে খুব যে অনিশ্চয়তা আছে বা কোনো সময়সীমা দেওয়া হয়নি– এমন নয়। নির্বাচন হয়ে গেলেই দেশ প্রবৃদ্ধির বিশাল এক ধারায় প্রবেশ করবে বলে মনে হয় না। আর বিনিয়োগ না হওয়ার একক কারণ নির্বাচন নয়। গ্যাস এবং অন্য সরকারি সেবা নিশ্চিত ও ব্যবসায় খরচ কমানো যায়নি। এগুলোও বিনিয়োগ না হওয়া বা প্রবৃদ্ধি কমার উল্লেখযোগ্য কারণ।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সবার আশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার সমন্বিত সংস্কার করবে। এর মাধ্যমে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা বাড়বে এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কাটিয়ে সক্ষমতা বাড়বে। অথচ এখনও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। সব কিছু নির্বাচনের জন্য রাখার দরকার নেই। যেমন দেশে লজিস্টিকস উন্নয়নে নীতিমালা বাস্তবায়নে নির্বাচনের জন্য অপেক্ষায় থাকার দরকার নেই। প্রত্যাশা ছিল, ডিজিটালাইজেশন হবে। বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানো হবে। এগুলো না হলে নির্বাচন করেও ফল মিলবে না। তিনি বলেন, বিনিয়োগ করতে উদ্যোক্তার মধ্যমেয়াদি সুস্থির পরিকল্পনা থাকে। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব– এমন নিশ্চয়তা তারা পাচ্ছেন না। ফলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। নির্বাচন পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে।

আগামী বাজেটে কোনো অবস্থাতেই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা ঠিক হবে না বলে সিপিডির অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এ সুযোগ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়, নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয় এবং রাজনৈতিকভাবেও ভালো কিছু আনবে না। তিনি বলেন, অর্থবছর শুরুর দ্বিতীয় মাসে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। তখন নতুন বাজেট করলে ভালো হতো। তবে বিদ্যমান প্রকল্পগুলো সরকার মূল্যায়ন করছে। ভুল-ত্রুটি সংশোধন করছে।  নতুন অগ্রাধিকার ঠিক করেছে, খরচও কমিয়েছে। এত কিছুর পরও সরকারের কাজে যে অসম্পূর্ণতা আছে– তা অস্বীকার করা যাবে না। আরও সমন্বিত করার সুযোগ আছে। এখন যে সংস্কার হচ্ছে, এর ফলাফল পরে পাওয়া যাবে। অর্থনীতির বর্তমান প্রধান চ্যালেঞ্জ বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিনিয়োগে চাঞ্চল্য আনা যায়নি। এখানে অনিশ্চয়তা আছে। গত কয়েক বছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ পিষ্ট হচ্ছে। এর থেকে উত্তরণে শোভন কর্মসংস্থান লাগবে। 

অর্থনীতি কোথায় দাঁড়িয়ে 
সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থবছরের প্রায় শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক জটিল সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স খাতে অগ্রগতি আছে। অন্যদিকে রাজস্ব সংগ্রহ, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাত ও জ্বালানি নিরাপত্তায় স্পষ্ট দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছে। চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে ঠেকিয়ে রাখার লক্ষ্য নিলেও তা ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত ১২ বছরে সর্বোচ্চ। সিপিডি মনে করছে, সরকারি চাকরিজীবীদের মহার্ঘ ভাতা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিতে পারে। 

গবেষণা সংস্থাটি বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত ২০২৪ সালের পর থেকে নেতিবাচক, যা এ খাতের গভীর সংকটকে প্রকাশ করে। খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায়, যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বার্ষিক বরাদ্দের চেয়েও বেশি। দুর্বল অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক নিযুক্তি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অভাব সমস্যা আরও বাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকায় এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। তবে মূলধি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়ায় বিনিয়োগ মন্থর রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, ভারতের অশুল্ক বাধার মতো ঘটনা সামনে এসেছে। এদিকে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও শেয়ারবাজারে একটি নতুন আইপিও হয়নি। বিনিয়োগকারীদের আস্থা দুর্বল। সংস্কার কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি ও সরবরাহ ঘাটতির ফলে শিল্প খাত মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়লেও গ্যাস সংকটে সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। অপরিকল্পিত খরচ, দুর্বল সমন্বয় এবং জবাবদিহির অভাব এ খাতকে অনিশ্চয়তায় ফেলেছে।

সিপিডি রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে নতুন উৎস অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছে।  কর ফাঁকি রোধ ও সংগ্রহ দক্ষতা বাড়াতে বলেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ, বাজার সিন্ডিকেট ভাঙা ও কৃষক-বাজার সংযোগ করার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া  খেলাপিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত, ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য, বাজার সম্প্রসারণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, শেয়ারবাজার সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন, গ্যাস অনুসন্ধান, নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগসহ আরও কিছু সুপারিশ করেছে সিপিডি।

আরও পড়ুন

×