উত্তম কৃষিচর্চা
কৃষকের বাজারে নিরাপদ আম

রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে কৃষকের বাজারে পাওয়া যাবে উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণ করে উৎপাদিত নিরাপদ আম সমকাল
জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫ | ০০:৫০ | আপডেট: ৩১ মে ২০২৫ | ১৩:২৫
সাতক্ষীরার কলারোয়ার ইলিশপুর গ্রামের আমচাষি কবিরুল ইসলামের চোখে এবার আশার দীপ্তি। হলুদ ব্যাগে মোড়া প্রতিটি আম তাঁর পরিশ্রম, শৃঙ্খলা আর কৃষিচর্চার ফসল। গতবার যেখানে পানির দরে আম বিক্রি করতে হয়েছিল, এবার প্রতি কেজিতে পাচ্ছেন ৯০–১০০ টাকা। নেই কোনো মধ্যসত্ত্বভোগী, নেই অনিশ্চয়তার ভয়। কারণ এবার তিনি আম চাষ করেছেন ‘উত্তম কৃষিচর্চা’ বা জিএপি পদ্ধতি অনুসরণ করে।
কবিরুলের সেই নিরাপদ আম এখন রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কৃষকের বাজারে পৌঁছেছে। সেসব আম ঘিরে ঢাকার ভোক্তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে বাড়তি আগ্রহ, আস্থা। শুক্রবার এই বাজারেই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হলো জিএপি পদ্ধতিতে উৎপাদিত নিরাপদ আমের বাজারজাতকরণ কার্যক্রম। উদ্বোধন করেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান।
জিএপি- গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসেস মানে শুধু একটি কাগুজে সনদ নয়। এর পেছনে আছে প্রশিক্ষণ, সচেতনতা, নির্ধারিত ধাপে উৎপাদন, নিরাপদ সংগ্রহ ও মানসম্মত বিপণনের প্রক্রিয়া। কবিরুল জানালেন, এবার সার, ওষুধ, পানি- সব কিছুই ব্যবহার করেছেন সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে। ফলাফল- তাঁর ভাষায়, ‘খরচ একটু বেশি হলেও লাভ বেশি। ঢাকায় প্রতি কেজিতে ২০-২৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।’ ন্যায্য দাম পেয়ে খুশি কবিরুলের মতো অন্য আমরা চাষিরাও। ঢাকার ভোক্তার চোখে এই আমের গল্প যেন হয়ে উঠছে দেশের কৃষি বদলের প্রতিচ্ছবি।
নিরাপদ আম উৎপাদন ও বাজারজাতের উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়, বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (ইফাদ) যৌথ অর্থায়নে পরিচালিত পার্টনার প্রোগ্রাম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও হর্টেক্স ফাউন্ডেশনও এই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত।
গুলশানের বাসিন্দা ফারহানা রহমান শুক্রবার এসেছিলেন কৃষকের বাজারে। হাতে কয়েক কেজি আম। বললেন, ‘সাধারণ বাজারে কীটনাশক নিয়ে ভয় থাকে। এখানে জিএপি লেখা দেখে কিনেছি। আমের ঘ্রাণ বেশ ভালো।’
এই আস্থা তৈরি হওয়ার পেছনে আছে সরকারি উদ্যোগ, কৃষকের আন্তরিকতা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক চর্চার সমন্বিত প্রয়াস। কৃষি সচিব বলেন, বাংলাদেশের আমের স্বাদ ও গুণমান ভালো হলেও রপ্তানিতে পিছিয়ে আছি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও মান নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতার কারণে। উন্নত কৃষিচর্চা ও গ্যাপ পূরণ করে এই ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশ থেকে এখন ৩৮টি দেশে আম রপ্তানি হয়। এ বছর যুক্ত হয়েছে চীন। গত বছর ১ হাজার ৩০০ টন আম রপ্তানি হয়েছিল। সরকারের লক্ষ্য, তা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টন করার।
আমের মৌসুম দীর্ঘ করতে এবং রঙ উন্নত করতে কাজ করছেন দেশের গবেষকেরা। তবে মান, নিরাপত্তা ও দ্রুত রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছু জায়গায় এখনও চ্যালেঞ্জ রয়েছে- বিশেষ করে কাস্টমস ও স্বাস্থ্যসনদ ইস্যুতে। কৃষি সচিব জানান, আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এসব সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চলছে।
পার্টনার প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর আবুল কালাম আজাদ জানালেন, দেশের ৮টি বিভাগ, ৬৪ জেলা ও ৪৯৫টি উপজেলায় এই কর্মসূচি বিস্তৃত। লক্ষ্য- ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে জিএপিভিত্তিক ফল ও সবজির আবাদ। এই কর্মসূচির আওতায় কৃষকদের দেওয়া হচ্ছে জিএপি প্রশিক্ষণ, সনদ, বাজার সংযোগ ও প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা। সঙ্গে আধুনিক সেচ ব্যবস্থা, সিড টেস্টিং ল্যাব ও স্মার্টকার্ডের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নাসির-উদ-দৌলা বলেন, কৃষকের বাজারের সঙ্গে যুক্ত আম চাষিরা নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থার সচেতন অংশ। তাঁদের আম বিশ্ব বাজারের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের কৃষি বদলাচ্ছে- উৎপাদনের ভেতর দিয়ে নয়, মান, নিরাপত্তা আর ভোক্তার আস্থায়।
হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. সৈয়দ মো. রফিকুল আমিন বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার পথে একটি সম্মিলিত বন্ধন তৈরি হচ্ছে- উৎপাদক, সরকারি সংস্থা, বিজ্ঞানী, রপ্তানিকারক ও ভোক্তার মধ্যে। জিএপি শুধু একটি চর্চা নয়, এটি নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থার প্রতি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতি। বিশ্বব্যাপী আমের জনপ্রিয়তাকে ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন মানসম্মত উৎপাদন, নিরাপদ সংরক্ষণ ও পেশাদার বিপণন।
হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের যুগ্ম পরিচালক মিতুল কুমার সাহা জানান, রাজধানীর কৃষকের বাজারে প্রতিদিন এক টন আম বিক্রি হবে। পুরো মৌসুমে সাতক্ষীরা, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর আম ঢাকায় আসবে সরকারি ব্যবস্থাপনায়। এতে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে না।