সরকারি ব্যয়ের ২৮ শতাংশই যাবে সুদ ও বেতন-ভাতায়

.
মেসবাহুল হক
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫ | ০০:৫৪ | আপডেট: ৩১ মে ২০২৫ | ০৮:৫১
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে চলতি বাজেটের চেয়েও ছোট বাজেট দিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী অর্থবছর সরকারি ব্যয় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকায় রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে সার্বিক বাজেট ছোট হলেও সরকারি ব্যয়ের সুদ পরিশোধ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় বরাদ্দ প্রায় ১১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের প্রায় ২৮ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেশ কয়েক অর্থবছর থেকেই রাজস্ব সংগ্রহ ভাটায় আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না এবং বছর শেষে সরকারকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিতে হয়। দেশি-বিদেশি এ ঋণের বিপরীতে গুনতে হয় বড় অঙ্কের সুদ। এতে করে পরিচালন বাজেটের একক খাত হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় সুদ পরিশোধে। আগামী অর্থবছরে সুদ পরিশোধে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের সুদ পরিশোধ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ খাতে ব্যয় আরও বেড়ে যেতে পারে।
চলতি অর্থবছরে সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৮৫ হাজার ২৫ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে ব্যয় ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ খাতে বাড়তি ব্যয়ের কারণ হিসেবে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কভিড-পরবর্তী বাজেট সহায়তা ও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়া হয়। দেশি-বিদেশি উৎসে এখন সরকারের মোট ঋণ প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকার মতো। কিছু প্রকল্পে বড় অঙ্কের স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়ায় দ্রুত সুদ ও কিস্তি পরিশোধের চাপ তৈরি হয়েছে, যা সরকারের ব্যয়ের সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের মতো বিদেশি ঋণের সুদের হারও বেড়েছে। বিশেষ করে জাপান, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এখন অনেক ঋণ বাজারভিত্তিক হারে দিচ্ছে। আরেকটি বড় কারণ হলো টাকার অবমূল্যায়ন। চলতি অর্থবছরে প্রতি ডলারে গড় বিনিময় হার ১২০ টাকা যা আগের বছর ছিল ১১১ টাকা। এ ছাড়া দেশে সুদহার বাজারভিত্তিক করায় স্থানীয় উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের খরচও বেড়ে গেছে। বর্তমানে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে সুদের হার ১০ থেকে ১২ শতাংশ, যা ২০২৩ সাল পর্যন্ত ছিল ৮ শতাংশ। এসব কারণেই সার্বিকভাবে সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে। তবে আগামী বাজেটে ঋণ কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। নতুন অর্থবছরে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দেশি ও বিদেশি মিলে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে যা ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা।
ঋণ ঝুঁকি কমানো সরকারের লক্ষ্য
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি জানিয়েছেন, বেশ কয়েক বছর বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বেশি পরিমাণে দেশি-বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার খুব বেশি ঋণ নিতে চায় না। এমনকি দেশকে ঋণের দুষ্টচক্র থেকে বের করতে জ্বালানি খাতে আগের সরকারের রেখে যাওয়া বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি বলেছেন, দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিলেও তার পরিমাণ সীমিত রাখতে চায় সরকার। সরকারের উদ্দেশ্য হলো, দেশের ঋণ ঝুঁকি ‘মধ্যম’ থেকে কমিয়ে ‘নিম্ন’ পর্যায়ে নিয়ে আসা।
বেতন-ভাতায় যাবে ৯৭ হাজার কোটি টাকা
সুদ পরিশোধের পরই পরিচালনা বাজেটের অন্যতম বড় খাত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা। চলতি বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ৮২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৬ শতাংশ বাড়িয়ে নতুন বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এর অন্যতম কারণ হলো, ১ম থেকে ৯ম গ্রেডের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ১৫ শতাংশ এবং ১০ম থেকে ২০তম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতার দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আগামী ১ জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীরা এ সুবিধা পেতে পারেন। এজন্য বাড়তি প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে।
অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তার সমকালকে বলেন, রাজস্ব আদায়ে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় উন্নয়নে বাজেটের পুরোটাই ঋণনির্ভর। এর আগে অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ঋণ নেওয়া হয়েছে, যা অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করেছে। কিছু ক্ষেত্রে অনেক বেশি সুদে ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলে অনেক প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত সুফল আসছে না, কিন্তু ঋণ পরিশোধের বোঝা বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, টেকসই উন্নয়নের জন্য আগামীতে ঋণ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। যথাযথ প্রক্রিয়ায় ঋণের অর্থ ব্যবহার করলে তা বোঝায় পরিণত হবে না। একই সঙ্গে অব্যবস্থাপনা কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ সমকালকে বলেন, সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়বে, যা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে সুদ পরিশোধের ব্যয় ভয়াবহ গতিতে বাড়ছে। তাই সরকারকে ঋণ নেওয়া কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভ্যাটের মতো পরোক্ষ করের পরিবর্তে প্রত্যক্ষ কারের ওপর বেশি জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে অটোমেশন বাস্তবায়নের মাধ্যমে ত্রুটি-বিচ্যুতি কাটিয়ে কর ফাঁকি রোধ করতে হবে।