তদন্ত কমিশনের সংবাদ সম্মেলন
গুমের শিকার ব্যক্তিদের চার ধরনের পরিণতি হয়েছিল
জড়িতরা এখনও ক্ষমতার কেন্দ্রে হুমকি দিচ্ছে ভুক্তভোগীদের

প্রতীকী ছবি
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫ | ০১:৩২ | আপডেট: ২০ জুন ২০২৫ | ০৯:২৮
গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছিল বলে জানিয়েছে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে নিজস্ব কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন কমিশনের প্রধান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
তিনি বলেন, কমিশনে জমা অভিযোগগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য চার ধরনের পরিণতি হয়েছিল। সেগুলো হলো– ভুক্তভোগীকে হত্যা। বিচারের আগেই ভুক্তভোগীকে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করে সাধারণত জঙ্গি তকমা দিয়ে বিচারাধীন বা নতুন ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো। ভুক্তভোগীকে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ভুক্তভোগীকে ছেড়ে দেওয়া।
কমিশন গত ৪ জুন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয়। সংবাদ সম্মেলনে কমিশনপ্রধান বলেন, ‘প্রতিবেদনে আমরা তুলে ধরেছি, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত দমননীতির অংশ হিসেবে গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও বহু অপরাধী এবং তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করায় অনেক জোরালো প্রমাণ ও নিদর্শন ধ্বংস করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, সাক্ষীদের ভয়ভীতিসহ নানা আতঙ্কজনক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এসব ব্যক্তির নাম প্রকাশ করলে ভুক্তভোগীদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে বলে প্রকাশ করা হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, বহু ভুক্তভোগী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের অভিযোগ ও অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। দেশীয়-আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিস্তারিতভাবে সে কাহিনি তুলে ধরেছেন। গোপন আটক কেন্দ্রের অস্তিত্ব এখন আর অস্বীকার করা যায় না। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা কিছু কেন্দ্র পরিদর্শন ও ভুক্তভোগীদের বক্তব্য শুনেছেন, যা গণমাধ্যমের কল্যাণে বিশ্বের মানুষ দেখেছে।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন (দ্য কমিশন অব এনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স) গঠিত হয়। কমিশন বলপূর্বক গুম ব্যক্তিদের সন্ধান, শনাক্ত, কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছিলেন, তা নির্ধারণে কাজ শুরু করে।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম জানান, কমিশন গঠনের পর গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর কথিত ‘আয়নাঘর’ নামে গোপন বন্দিশালার স্থান-স্থাপনা পরিদর্শন করেন তারা। এ পর্যন্ত ১৬টি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেছেন। বিভিন্ন সময় তথ্য পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। কমিশনে জমা পড়া থেকে ১৩১টি অভিযোগের বিষয়ে এফআইআর বা জিডি করে ভুক্তভোগীদের সন্ধান ও উদ্ধারের জন্য আইজিপিকে বলা হয়েছে।
দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে প্রায় ১ হাজার ৮৫০ অভিযোগ বিশ্লেষণ করে গুমের শিকার ২৫৩ জনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। কমিশন বলেছে, এ ক্ষেত্রে তিনটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রথমত, নিখোঁজ হওয়ার সময় ভুক্তভোগীর নিকটাত্মীয়ের করা জিডি, ফৌজদারি মামলা, গুম থাকা অবস্থায় সংবাদ প্রতিবেদনের মতো সমসাময়িক প্রমাণ রয়েছে। শুধু এই ২৫৩ জন সমসাময়িক প্রমাণ দাখিল করতে সক্ষম হয়েছেন। বাকিরা হননি। কারণ, তখন এসব ক্ষেত্রে জিডি করতে গেলে নেওয়া হতো না। দ্বিতীয়ত, গুম অবস্থা থেকে ফেরতের সময় ভুক্তভোগীদের সন্ত্রাসবিরোধী মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোনো একটি সংস্থা স্বীকার করে নেয়, ব্যক্তিটি তাদের হেফাজতে আছে। তৃতীয়ত, ভুক্তভোগীরা জীবিত আছেন, তাই কমিশনকে তারা রাষ্ট্রীয় হেফাজতে গোপন আটক কেন্দ্রে বন্দির কথা জানাতে পেরেছেন। সেখানে তাদের অনেকের একে অপরের সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং তারা একই ধরনের নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। অর্থাৎ এই ২৫৩ ব্যক্তিকে গুম করার মুহূর্তে, গুমকালীন ও গুম থেকে ফেরত আসার সময়– তিনটি পর্যায়েই অকাট্য প্রমাণাদি পাওয়া যাচ্ছে।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমাদের কাছে ২৫৩ জনের তথ্যভিত্তিক দলিল রয়েছে, যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং এক দশকের বেশি সময় একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এমন ঘটনা কাকতালীয় হওয়া সম্ভব নয়; এমনকি হাতেগোনা কতিপয় অবাধ্য কর্মকর্তার বিচ্ছিন্ন অপরাধও হতে পারে না। এ অভিজ্ঞতার সাদৃশ্যতা একটি সাংগঠনিক ও পদ্ধতিগত কাঠামোর অস্তিত্ব নির্দেশ করে। স্পষ্ট হয়, বিগত শাসনামলে গুম একটি সুশৃঙ্খল ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপে ‘জঙ্গিবাদবিরোধী’ অভিযানের ছায়াতলে ইসলামী উগ্রবাদের হুমকিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন এবং শাসন দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে। এর ভুক্তভোগী ছিলেন মেধাবী শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পেশাজীবী তথা সাধারণ মানুষ।’’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে দাখিল ৮১ শতাংশ অভিযোগ জীবিত ভুক্তভোগীর হলেও, ১৯ ভাগ ফেরত না আসা ব্যক্তিদের। প্রতিবেদনে এবার আমরা গুম অবস্থা থেকে ফিরে না আসা এমন ১২ জনের বিষয়ে অগ্রগতি তুলে ধরেছি। তাদের বিষয়ে আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষ হয়েছে এবং তাদের গুম করার জন্য কারা দায়ী, তা প্রাথমিকভাবে আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি।’
কমিশনপ্রধান বলেন, ‘‘প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে দুটি সুপারিশ করা হয়েছে। প্রথমত, সন্ত্রাসবিরোধী মামলার অপব্যবহারের বিষয়ে অবগত হয়ে সেগুলো ন্যায়বিচারের মানদণ্ড বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনস্তত্ত্ব পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমান ‘কাউন্টার টেররিজম মেথড’ ত্রুটিপূর্ণ বিধায় মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার মতো উপযুক্ত ‘কাউন্টার টেররিজম মেথড’ বের করা।’’
তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ গোটা বিশ্বের বাস্তব হুমকি; বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিসানে হামলার মতো ঘটনা এর প্রমাণ। এ হুমকি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের সততা, মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি ও আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় অটল থাকা জরুরি। সরকার সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারকে যখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তখন তা আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়।’
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনী গুমের সঙ্গে জড়িত নয়
সেনাবাহিনী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গুমের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও, বিভিন্ন বাহিনীতে ডেপুটেশনে থাকা এই বাহিনীর সদস্যরা জড়িত ছিলেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান বিচারপতি মইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এটি ঠিক গুমের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনী জড়িত নয়। কিন্তু ডিজিএফআই, এনএসআই ও র্যাবের বিশেষ করে কমান্ডিং অফিসাররা কিন্তু সেনাবাহিনীর। গুমের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। বেসিক্যালি তারা তো আর্মড ফোর্সেসের অফিসার। তারা আর্মির হতে পারে, নেভির হতে পারে, এয়ারফোর্সেরও হতে পারে।’
এ বিষয়ে কমিশনের সদস্য মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘তারা (সেনাবাহিনী) জানত না, এটি বলার সুযোগ নেই। তাদের সাবেক এক সেনাপ্রধান পাবলিক স্টেটমেন্ট দিয়েছেন– দুইজন সেনা সদস্য এ ধরনের কাজে যুক্ত হতে চান না বলে তাঁর কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। তারা অফিসিয়ালি ইনভলভ ছিল না। কিন্তু জানত না, এটি বলার সুযোগ নেই।’
- বিষয় :
- গুম