সিলেটের ভোলাগঞ্জ
নিরাপত্তা বাহিনীর সামনেই রেল বাঙ্কারের পাথর লুট

রেলওয়ের জায়গা ‘বাঙ্কার এলাকা’ থেকে এভাবেই বালু-পাথর লুট করে শ্রমিকরা। সম্প্রতি তোলা -ইউসুফ আলী
তৌফিকুল ইসলাম বাবর, চট্টগ্রাম ও মুকিত রহমানী, সিলেট
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫ | ০১:১৩ | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৫ | ০৮:১৬
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির কাছেই রেলওয়ের মালিকানাধীন পাথর কোয়ারি, যা ‘রেলের বাঙ্কার’ নামে পরিচিত। এই বাঙ্কারের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি)। এলাকাটি ভারতের সীমান্তবর্তী হওয়ায় সেখানে দায়িত্ব পালন করেন বিজিবি সদস্যরাও। এটি সংরক্ষিত এলাকা হওয়ায় এখান থেকে পাথর সংগ্রহের সুযোগ নেই। তারপরও নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা আছেন, সেই আরএনবি সদস্যদের চোখের সামনেই লুট হচ্ছে পাথর। ‘নীরব’ থাকার বিনিময়ে পকেট ভারী হচ্ছে আরএনবি সদস্যদের। এ টাকার ভাগ পান বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও। অভিযোগ রয়েছে, পাথর লুট নির্বিঘ্ন করতে ‘চুপ’ রাখতে হয় বিজিবি সদস্যদেরও। এ জন্য নির্দিষ্ট হারে টাকা দিতে হয় তাদেরও!
ভোলাগঞ্জে রেলওয়ের পাথরের বাঙ্কার এলাকায় সম্প্রতি দেখা যায়, বাঙ্কারের চারদিকে নৌকা আর নৌকা। প্রতি নৌকায় দুই-তিনজন লোক। তাদের কেউ বেলচা, কেউ কোদাল-শাবল দিয়ে পাহাড়-টিলা থেকে মাটি খুঁড়ে পাথর বের করছে। সেই পাথর নৌকায় তোল হচ্ছে। নৌকাভর্তি হলেই নিয়ে যাচ্ছে আশপাশ এলাকায় নিজেদের ডেরায়। অথচ পাথরের বাঙ্কারের আশপাশেই দেখা গেছে আরএনবি ও বিজিবি সদস্যদের। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে রীতিমতো বাঁশের খুঁটিতে ত্রিপল ও প্লাস্টিকের ছাউনি লাগিয়ে পাথর সংগ্রহ করছে শত শত মানুষ। দেখেও না দেখার ভান করে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
রেলওয়ের বাঙ্কারের আয়তন প্রায় ৩৫০ একর। এ পর্যন্ত এটির প্রায় ৮০ শতাংশ পাথর তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে টিলাগুলো প্রায় সমতল ভূমিতে রূপ নিয়েছে। স্থানে স্থানে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য গর্ত। বৃষ্টির পানিতে ডোবায় পরিণত হয়েছে গর্তগুলো।
পরিচয় গোপন রেখে পাথর সংগ্রহকারী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন শতাধিক নৌকায় পাথর তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতি নৌকায় পাথর নেওয়া হয় দিনে দুই-তিনবার। আকারভেদে প্রতিটি নৌকা থেকে আরএনবি সদস্যরা নেয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা; বিজিবি সদস্যরা নেয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। দুই বাহিনীর নিয়োজিত লোকজন নৌকা থেকে এ টাকা তোলে। আকার অনুযায়ী প্রতি নৌকা পাথর ৩ থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ভোলাগঞ্জের ১০ নম্বর ঘাটসহ স্থানীয় ধলাই নদীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে চোরাই পাথর বেচাকেনার হাট! মাঝেমধ্যে প্রশাসন অভিযান চালালেও বন্ধ করা হচ্ছে না পাথর লুট।
সুনামগঞ্জের শাল্লার বাসিন্দা রহিম আলী পেশায় ধানকাটা শ্রমিক। স্থানীয় কাঁঠালবাড়ী এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেনও শ্রমজীবী। এ ধরনের শ্রমজীবী মানুষ ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে ভোলাগঞ্জের রেলওয়ের বাঙ্কার থেকে পাথর তুলে নিয়ে যাচ্ছে। পরিচয় গোপন করে আলাপকালে রহিম আলী ও কামাল হোসেন জানায়, পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন থেকে বিভিন্ন সময় অভিযান চালানো হয়। অভিযানের খবর আমরা আগেই পেয়ে যাই। তবে পাথর উত্তোলনের জন্য আরএনবি ও বিজিবি সদস্যদের নৌকাপ্রতি নির্দিষ্ট হারে টাকা দিতে হয়।
আরএনবির একাধিক কর্মকর্তা ও সদস্য নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে সমকালকে বলেন, দায়িত্বরত আরএনবি সদস্যদের যোগসাজশেই পাথর তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিষয়টি এখন অনেকটাই ‘ওপেন সিক্রেট’। কারণ পাথর সংগ্রহে যেসব নৌকা ব্যবহার হয়, প্রতিটি থেকে নির্দিষ্ট হারে টাকা নেওয়া হয়। এই টাকার ভাগ যায় বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে। ফলে এ নিয়ে কর্মকর্তারাও চুপ থাকেন।
সিলেট হচ্ছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অধীনে। এ অঞ্চলের সদরদপ্তর চট্টগ্রামের সিআরবিতে। পাথর লুটপাট ও টাকা আদায়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আরএনবি পূর্বাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্ট মো. আশাবুল ইসলাম সমকালকে বলেন, এ কথা ঠিক, ভোলাগঞ্জে রেলওয়ের বাঙ্কার থেকে পাথর লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি এটি বন্ধ করতে। তবে টাকার বিনিময়ে পাথর নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়টি সত্য নয়।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ঢাকা বিভাগের আওতায় পড়েছে রেলের বাঙ্কারটি। এ ব্যাপারে আরএনবি ঢাকা বিভাগের কমান্ড্যান্ট শফিকুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এক সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা পর্যন্ত জারি করতে হয়েছে। পাথর লুটকারীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ আমি খতিয়ে দেখব।
বিজিবির সিলেট ব্যাটালিয়নের (৪৮ বিজিবি) অধিনায়ক লে. কর্নেল নাজমুল হক সমকালকে বলেন, বিজিবি মূলত সীমান্ত রক্ষায় কাজ করে। উপজেলা প্রশাসন চাইলে সহযোগিতা করা হয়।
- বিষয় :
- পাথরখনি