জুলাই হত্যার বিচার
আইসিটিতে ৩ মামলার অভিযোগ আমলে, তদন্ত চলছে ২৪টির

ফাইল ছবি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫ | ০১:৩৮ | আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৫ | ২২:৪৯
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে হত্যা, নির্যাতনসহ সহিংসতার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে সারাদেশে দেড় হাজারের বেশি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা হয়েছে চার শতাধিক। অপহরণ, হত্যাচেষ্টা ও সহিংসতার অভিযোগে বিভিন্ন মামলায় শেখ হাসিনাকে নির্দেশদাতা, হুকুমদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে প্রধান আসামি করা হয়েছে। এদিকে, গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা মামলার মধ্যে তিনটির আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনাল যে তিনটি মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়েছেন, সেগুলো হলো– শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা, রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয় হত্যা মামলা ও রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা মামলা।
শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করা হয় গত বছরের ১৩ আগস্ট। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মুদি দোকানদার আবু সায়েদ হত্যার অভিযোগে ঢাকার আদালতে দায়ের করা মামলার তদন্ত চলছে। ট্রাইব্যুনাল তিনটি মামলার অভিযোগ আমলে নিলেও সারাদেশে থানা ও আদালতে দায়ের করা অন্য কোনো মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। এদিকে, গণহারে করা মামলার উপাদান বা মেরিট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, শেখ হাসিনা ও অন্যদের বিরুদ্ধে যেভাবে গণহারে আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়েছে, তাতে হয়রানি ছাড়া কিছু হবে না। ভবিষ্যতে মামলার সুবিচার নিয়ে সন্দিহান তারা। সরকারের একাধিক উপদেষ্টাও এসব মামলায় গণহারে অজ্ঞাত আসামি করা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
এসব মামলা দায়ের করা প্রসঙ্গে রোববার আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘ভুয়া মামলা দায়ের এবং নিরপরাধ ব্যক্তিকে অকারণে মামলায় জড়িয়ে বাণিজ্য করা হচ্ছে। এসব থেকে মুক্তি পেতে আমরা আইন সংশোধনের পথে এগিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘মামলা বাণিজ্য ও ভুয়া মামলা ঠেকাতে প্রাথমিক তদন্তে যদি কোনো আসামির সম্পৃক্ততা পাওয়া না যায়, তাহলে প্রাথমিক পর্যায়েই তার নাম বাদ দেওয়ার বিধান রেখে নতুন আইনের অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। খুব শিগগির তা গেজেট প্রকাশ করা হবে।’
চানখাঁরপুলের মামলা
গণঅভ্যুত্থানের সময় চানখাঁরপুলে শিক্ষার্থী শাহরিয়ার খান আনানসহ ছয়জনকে হত্যার অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) গঠনের বিষয়ে প্রসিকিউশন পক্ষের শুনানি শেষ হয়েছে। পলাতক চার আসামির পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত (স্টেট ডিফেন্স) আইনজীবীর বক্তব্যসহ মোট আট আসামির পক্ষে শুনানির জন্য ৩ জুলাই দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল রোববার এই আদেশ দেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এটিই প্রথম মামলা, যেটির আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে শুনানি শুরু হলো।
হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি আজ
গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) গঠনের বিষয়ে আজ মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালে শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে। একই সঙ্গে পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমীর হোসেনের বক্তব্য শুনবেন ট্রাইব্যুনাল। এই মামলার অপর দুই আসামি হলেন পলাতক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও কারাগারে থাকা সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
আবু সাঈদ হত্যা মামলা
রংপুরের আবু সাঈদ হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) গতকাল আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে এই মামলার ৩০ আসামির মধ্যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি পলাতক হাসিবুর রশীদসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ গতকাল অভিযোগ আমলে নিয়ে এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে ১০ জুলাই পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিন আসামিদের হাজির করতে বলা হয়েছে।
অন্যান্য মামলা
সাভারের আশুলিয়ায় গুলি করে হত্যার পর লাশ পোড়ানোর ঘটনায় ১৬ জনের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে প্রসিকিউশনে দাখিল করা হয়েছে। তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে আজ ১ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করার জন্য দিন ধার্য রয়েছে। তা ছাড়া যাত্রাবাড়ীতে হত্যা মামলা, রামপুরায় হত্যা মামলা, উত্তরায় হত্যা মামলা, মিরপুর জাহাজবাড়ীতে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে হত্যা মামলা, মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যার মামলাসহ বেশ কয়েকটি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খুন, হত্যাচেষ্টা, গুম, নির্যাতন, অপহরণসহ মানবতাবিরোধী নানা অপরাধের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে ৩৫৮টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর অধিকাংশই ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় পাঠানো হয়েছে। এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রসিকিউশনে চারটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ২৮টি।
তদন্ত সংস্থার প্রধান আনসার উদ্দিন খান পাঠান সমকালকে বলেন, জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের যেসব অভিযোগ প্রসিকিউশন থেকে পাঠানো হচ্ছে, সেগুলো যথাযথভাবে তদন্ত সংস্থা থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে দাখিল করা হয়েছে। জুলাই মাসে কমপক্ষে আরও ১০টি তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে জমা দেওয়া হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
গুমের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ফের পেছাল
গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২৪ আগস্ট পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। তদন্ত সংস্থার দুই মাস সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গত ২৪ জুন এ আদেশ দেন। শেখ হাসিনা ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানসহ ১১ জন এই মামলার আসামি।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত ১১ মাসে করা হত্যা মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও তাঁর বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, সাবেক স্পিকার, সাবেক মন্ত্রী-এমপি, পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, র্যাব কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, ১৪ দলের নেতা, আইনজীবী, অভিনেতা, খেলোয়াড়, প্রবাসীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীকে আসামি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, এমপি, পুলিশের দুই আইজিসহ সাড়ে ৩০০ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। অধিকাংশ মামলাতেই এজাহারের বর্ণনা প্রায় অভিন্ন। এখন পর্যন্ত মামলায় আসামির সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়েছে। আরও রয়েছে অসংখ্য অজ্ঞাত আসামি।
অভিযোগ উঠেছে, বেশ কিছু মামলায় ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক স্বার্থ, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছাড়াও হীন উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা রয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগের বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা উল্লেখ করেও মামলা হচ্ছে। এসব আসামি অনেকেরই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়টি অস্পষ্ট। কিছু মামলার ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। সব মিলিয়ে মামলার আসামি ও মামলা করা নিয়ে জনমনে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘আমার মনে হয় না, এসব মামলা পুলিশ সঠিকভাবে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারবে। পুলিশ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিচার হয়ে থাকে। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য-প্রমাণ না পাওয়া গেলে আদালত কীভাবে বিচার করবেন?’ তিনি আরও বলেন, ‘পাইকারি হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে।’
- বিষয় :
- জুলাই হত্যাকাণ্ড
- বিচার শুরু