ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

সংলাপে ঐকমত্য না হওয়ায় পেছাচ্ছে জুলাই সনদ

সংলাপে ঐকমত্য না হওয়ায় পেছাচ্ছে জুলাই সনদ

.

রাজীব আহাম্মদ

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫ | ০১:১৯ | আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৫ | ০৭:৫৮

সংস্কারের সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হওয়ায় পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ১৬ জুলাই হচ্ছে না ‘জুলাই সনদ’। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সমকালকে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ১৬ জুলাই ‘জুলাই সনদ’ সই সম্ভব নয়। তবে এখনও আশা করছি, জুলাইয়েই হবে সনদ। 

সংস্কার তথা জুলাই সনদ প্রণয়নের লক্ষ্যে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে মত চায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রথম ধাপের সংলাপে মতামত দেওয়া ৩৩ দল ও জোটের সঙ্গে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে ৪৫টি বৈঠক করে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম ধাপে দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে সংলাপ করে কমিশন।

গত ২ জুন প্রধান উপদেষ্টার অংশগ্রহণে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শুরু হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দফা সংলাপে ১৪৫ সংস্কার প্রস্তাবের নিষ্পত্তি হয়। বাকি ২১টি নিয়ে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ চলছে। ৩ জুন থেকে সাত দিনের সংলাপে মাত্র ৯টি বিষয় আলোচিত হয়েছে।

এর মধ্যে ৭০ অনুচ্ছেদ শিথিল করা এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার প্রস্তাবে দ্বিতীয় দফার সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০ দল ও জোট মোটামুটি একমত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ ১০ বছর নির্ধারণে ২৫ দল একমত হলেও বিএনপিসহ পাঁচটি শর্তসাপেক্ষে সম্মতি জানিয়েছে। প্রধান বিচারপতি কে হবেন প্রস্তাবে, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুই বিচারপতির একজনকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন– এ বিষয়েও দলগুলোর অবস্থান প্রায় কাছাকাছি। বাকি পাঁচ বিষয় নিয়ে বারবার আলোচনা হলেও ঐকমত্য হয়নি।

কমিশন প্রস্তাব করেছে, সংসদ হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। উচ্চকক্ষ হবে ১০৫ আসনের। পাঁচজন মনোনীত হবেন রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তিতে তা বাদ পড়েছে। দুটি ছাড়া সব দল ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠনে একমত হয়েছে।

তবে কীভাবে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে– এ নিয়েই সবচেয়ে বেশি মতবিরোধ চলছে। বিএনপি চায়, সংসদে প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বাকি দলগুলো চাইছে, নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন হোক। সাত দিনের সংলাপে চার দিন এ বিষয়ে আলোচনা হলেও ঐকমত্য হয়নি।

বিএনপির ভাষ্য, আনুপাতিক পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ হলে সংবিধান সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো দল কখনোই পাবে না। অন্যান্য দল বলছে, তারা এটাই চায়, যেন কখনও সরকার এককভাবে সংবিধান পাল্টে ফেলতে না পারে।

গত রোববারের সংলাপে গণসংহতির জোনায়েদ সাকি জানতে চান, সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিধান করা হলে বিএনপি আনুপাতিক পদ্ধতি মানবে কিনা? কমিশন এবং রাজনৈতিক দলের সূত্র জানিয়েছে, এ প্রস্তাব ছাড়াও বিএনপিকে রাজি করাতে উচ্চকক্ষের অর্ধেক নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে, অর্ধেক ভোটের অনুপাতে করা যায় কিনা– এ আলাপও রয়েছে। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, আলোচনার টেবিলে এমন প্রস্তাব নেই। 

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সমকালকে বলেন, আনুপাতিক নির্বাচনই মৌলিক সংস্কার। কারও জন্য তা আটকে থাকতে পারে না।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন সমকালকে বলেন, উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব এলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। উচ্চকক্ষ আনুপাতিক এবং সংবিধান সংশোধনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিধান থাকতে হবে। 

বিএনপি রাজি না হওয়ায় জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) পরিবর্তে কমিশন ‘সাংবিধানিক এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব করেছে।

প্রধানমন্ত্রী, সংসদের উভয় কক্ষের স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, প্রধান বিরোধী দল বাদে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা অন্য দল থেকে একজন এমপি, রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি এবং প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সাত সদস্যের এ কমিটি নির্বাচন কমিশন (ইসি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), মানবাধিকার কমিশন ও প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার কমিশনে নিয়োগ দেবে।

বিএনপি এতে রাজি না হলেও অন্যরা একমত। সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমবে যুক্তিতে নিয়োগ আইনগুলোর সংস্কার চায় দলটি।

কমিশনের এক সদস্য জানিয়েছেন, কমিটি না করে অন্য কোনো পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবমুক্ত করা যায় কিনা, তা ভাবা হচ্ছে। 
অপর দুই প্রস্তাব রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি এবং মূলনীতি নিয়েও ঐকমত্য হয়নি।

আলী রীয়াজ সমকালকে বলেন, মৌলিক সংস্কারের একটিতে ঐকমত্য হলে দেখা যাবে, অন্যগুলোতেও দলগুলো কাছাকাছি এসেছে। 

সনদ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন হবে কিনা– এমন প্রশ্নে কমিশনের সহসভাপতি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যে সময়সীমা বলেছেন, এর ভেতরেই নির্বাচন হবে বলে মনে করি। নির্বাচন কমিশন ভোটের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করছে।

সংলাপে ঢিলেমি আছে বলে মনে করলেও সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সনদের কারণে নির্বাচন আটকে থাকার কারণ নেই। বিএনপি ১৬৬ সুপারিশের ৯০ শতাংশের বেশিতে আগেই একমত হয়েছে। বিএনপি সংস্কারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। আশা করছি, চলতি মাসেই সনদ হয়ে যাবে।

অন্য দলগুলোর নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট, সংস্কারের বিষয়ে ফয়সালা ছাড়া সনদে সই হবে না। ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে তা জানিয়ে দিয়েছে এনসিপি। দলটি বলেছে, সংস্কার না হলে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বলছে, নির্বাচন আয়োজনের আগে সংস্কার হতে হবে।

জামায়াতের ডা. তাহের বলেছেন, নির্বাচনের জন্য অবশ্যই সংস্কার হতে হবে।

আরও পড়ুন

×