আদালতে সাবেক সিইসির জবানবন্দি
রাতে ভোট হওয়ার কথা স্বীকার নূরুল হুদার
পদত্যাগের বিষয়ে কিছুই করার ছিল না

কে এম নূরুল হুদা
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫ | ০১:২৪ | আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৫ | ০৮:২৬
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। তিনি বলেছেন, ওই নির্বাচন ছিল অসংগতিপূর্ণ। কোনো কোনো কেন্দ্রে ৯০-১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে। ভোটের এ হার দেখে তিনি বিব্রত হয়েছিলেন। ভোট নিয়ে এ ধরনের জালিয়াতির পরও কেন পদত্যাগ করেননি– প্রশ্নে নূরুল হুদার দাবি, ‘আমার কিছুই করার ছিল না।’
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) জিজ্ঞাসাবাদে এসব কথা নূরুল হুদা বলেছেন– এমন ভাষ্য পুলিশের। নির্বাচনে জালিয়াতির ঘটনা তিনি আদালতে বলতে চান– পিবিআই কর্মকর্তাদের কাছে এমন অভিব্যক্তি জানান। এর পর গতকাল মঙ্গলবার নূরুল হুদাকে আদালতে হাজির করা হয়। গতকাল রাতে তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র এসব তথ্য জানায়।
ভোট ছাড়া নির্বাচন, রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা ও আস্থা ভঙ্গের মামলায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন নূরুল হুদা। গতকাল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এসিএমএম) জিয়াদুর রহমান তাঁর জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এর আগে নূরুল হুদাকে দু’দফায় হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই।
পিবিআই উত্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি এনায়েত হোসেন মান্নান সমকালকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে ভোটে অসংগতির কথা স্বীকার করেছেন নূরুল হুদা। আদালতে এ ব্যাপারে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে চেয়েছেন তিনি।
আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চার দিনের হেফাজত শেষে নূরুল হুদাকে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়। পরে তাঁর ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক সৈয়দ সাজেদুর রহমান।
জবানবন্দির বিষয়ে পুলিশের আবেদনে বলা হয়, সাবেক সিইসি এ কে এম নূরুল হুদা চার দিনের জিজ্ঞাসাবাদে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের অনিয়ম ও দিনের ভোট রাতে আয়োজনের মাধ্যমে ব্যালট বাক্সভর্তি করার অপরাধের বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দিতে নিজে সম্মতি দিয়েছেন।
২০১৮ সালে সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ায় শেখ হাসিনা ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর নূরুল হুদার মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন তিনি।
নূরুল হুদা আরও বলেছেন, তৎকালীন সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাসহ নির্বাচন কমিশনাররা পূর্ণ সহায়তা করে অবৈধভাবে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন সমাপ্ত করার পরিকল্পনা করেন। নূরুল হুদাসহ অন্য নির্বাচন কমিশনাররা ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিতদের মাধ্যমে দিনের ভোট রাতে আয়োজনের মাধ্যমে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখেন।
নূরুল হুদা ৩০ ডিসেম্বর সকালে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের এবং বিএনপির ছয় প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে গেজেট প্রকাশ করেন বলেও জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।
আরেকটি সূত্রের দাবি, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নূরুল হুদা বলেছেন, নির্বাচনে অনেক সুবিধাভোগী পক্ষ ছিল। তাদের চাপ ছিল। এ ছাড়া তাঁর কাছে নির্বাচনে অবৈধ টাকা-পয়সার লেনদেনের ব্যাপারে জানতে চায় পুলিশ।
গত ২২ জুন উত্তরায় মব তৈরি করে নূরুল হুদাকে পুলিশে দেওয়া হয়। পরদিন তাঁর চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এর পর গত শুক্রবার তাঁকে আবারও চার দিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত।
গত ২৫ জুন রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে আরেক সাবেক সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন তাঁর তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শেষে রোববার তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
গত ২২ জুন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব ‘পালন না করে’ উল্টো ‘ভয়ভীতি দেখিয়ে’ জনগণের ভোট ছাড়াই নির্বাচন সম্পন্ন করার অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় ২৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করে বিএনপি। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং মামলা, গুম, খুন ও তথ্য সংরক্ষণ সমন্বয়ক সালাহ উদ্দিন খান এ মামলার বাদী। পরে গত ২৫ জুন এ মামলায় নতুন করে রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ধারা যুক্ত করা হয়।
গত ২২ জুনের এ মামলায় ২০১৪ সালের নির্বাচনের সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, ২০১৮ সালের নির্বাচনে সিইসি এ কে এম নূরুল হুদা ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক ১০ নির্বাচন কমিশনার, সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার, এ কে এম শহীদুল হক, জাবেদ পাটোয়ারী, বেনজীর আহমেদ ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়েছে।
এজাহারে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে। তারা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করে উল্টো ভয়ভীতি দেখিয়ে জনগণের ভোট ছাড়াই নির্বাচন করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
- বিষয় :
- কে এম নূরুল হুদা