ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

দুর্নীতি দমন কমিশন

পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলা পুনঃতদন্ত করবে দুদক

প্রমাণ না পাওয়াসহ ১৬ কারণে দেওয়া হয় চূড়ান্ত প্রতিবেদন

পদ্মা সেতু দুর্নীতির মামলা পুনঃতদন্ত করবে দুদক

পদ্মা সেতু

সমকাল প্রতিবেদক 

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫ | ০১:৪৫ | আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৫ | ০৮:৩০

পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলা আবার সামনে এলো। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলাটি পুনঃতদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসএনসি-লাভালিনকে পরামর্শক হিসেবে কাজ পাইয়ে দিতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে এই মামলা করা হয়েছিল।

গতকাল মঙ্গলবার দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির যথেষ্ট উপাদান ও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বিগত কমিশন গায়ের জোরে অভিযুক্তদের মামলা থেকে দায়মুক্তি দিয়েছিল। বর্তমান কমিশন পুনঃতদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

রাজধানীতে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন আবদুল মোমেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগ নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছিল, সেটিকে কেন্দ্র করেই মামলা হয়েছিল। মামলার উপাদানগুলো সঠিক থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত আদালতে এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দাখিল করে নিষ্পত্তি করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, গত বছর ডিসেম্বরে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয়। এতে কমিশনের মনে হয়েছে, বিগত কমিশন অনেকটা গায়ের জোরে অভিযুক্তদের মামলা থেকে দায়মুক্তি দিয়েছে। এ বিষয়টি আমলে নিয়ে পুনঃতদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মামলাটি পুনঃতদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুদক উপপরিচালক মো. তানজির হাসিব সরকারকে।

বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনকে পরামর্শক হিসেবে কাজ পাইয়ে দিতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়াসহ সাতজনকে আসামি করে দুদক মামলা করেছিল ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর। মামলাটি প্রায় দুই বছর তদন্তের পর তৎকালীন কমিশন দুর্নীতির আমলযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। 

সাতজন আসামি
দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে যে সাতজনকে আসামি করা হয়েছিল তারা হলেন– সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়া, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদীশাসন) কাজী ফেরদাউস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (ব্রিজ কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স ডিভিশন) রিয়াজ আহমেদ জাবের, বাংলাদেশে এসএনসি-লাভালিনের সাব-কনসালট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট লিমিটেডের ডিএমডি গোলাম মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল, একই বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও এসএনসি-লাভালিনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস। 

সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর নাম বাদ দিয়ে মামলা করা হয়েছিল
এসএনসি-লাভালিনকে পরামর্শক হিসেবে কাজ পাইয়ে দিতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে করা ওই মামলায় আসামির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল ওই সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন (প্রয়াত) ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর নাম। তবে মামলার কপিতে সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম রাখা হয়েছিল। ওই সময় কমিশন থেকে বলা হয়েছিল, মামলা তদন্তে দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেলে তাঁকে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পরে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

‘ফৌজদারি অপরাধ হয়েছিল’
গতকালের ব্রিফিংয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, অপরাধমূলক অসদাচরণ করে ও বিধি-বিধান ভঙ্গ করে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্মাণকাজে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম দরদাতা এসএনসি-লাভালিনকে কার্যাদেশ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফৌজদারি অপরাধ করা হয়েছিল। অভিযুক্তরা দণ্ডবিধির ১৬১ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারার অপরাধ করার অভিপ্রায়ে দণ্ডবিধির ১২০(বি) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, সরকারি বিধিবিধান মেনে, পিপিএ, পিপিআর পুরোপুরি অনুসরণ করেই কাজ করতে হয়। এতে যে মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটি একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। অসৎ উদ্দেশ্যে কিংবা অপরাধ প্রবণতার কারণে তা করা হয়েছিল। 

রেহাই দেওয়া হয়েছিল ৯ জনকে
মামলার ওই সাত আসামি, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল।

এই প্রতিবেদন দাখিলের সময় কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন মো. বদিউজ্জামান। ২০১২ সালে মামলাটি করার সময় চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন গোলাম রহমান। দুটি পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন তখন কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। 

১৬ কারণ দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন
মোট ১৬টি কারণ উল্লেখ করে পদ্মা সেতু দুর্নীতি ষড়যন্ত্র মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে– আদালতে উপস্থাপনযোগ্য দালিলিক প্রমাণ ও নিরপেক্ষ সাক্ষী না পাওয়া। বলা হয়েছে, প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উত্থাপিত হলেও বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো দাতা সংস্থা থেকে অর্থ ছাড় করা হয়নি। তদন্তকালে অনৈতিকভাবে আর্থিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী পরামর্শক নিয়োগ-সংক্রান্ত বিষয় মূল্যায়ন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সম্মতি নিয়েই সেতুর বিভিন্ন দিক মূল্যায়ন করে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। পরামর্শক নিয়োগে টেন্ডার প্রক্রিয়ার প্রতিটি কাজ বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী স্বচ্ছতার সঙ্গে করা হয়েছে। অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর (প্রয়াত) নেতৃত্বে মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নে বিশ্বব্যাংকের কোনো প্রশ্ন বা অভিযোগ ছিল না।

সেতুর মূল্যায়ন কাজে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব প্রভাবিত করেননি বা বিশেষ কোনো কোম্পানির পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা প্রদান করেননি। মূল্যায়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও প্রকিউরমেন্ট বিশেষজ্ঞ ড. দাউদ আহমেদ। মূল্যায়ন কমিটি সেতু প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে কানাডার এসএনসি-লাভালিনকে নির্বাচিত করেছিল বিশ্বব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী।

কানাডার আদালতও পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি, নানাভাবে চেষ্টা করেও লাভালিন কর্মকর্তা রমেশ শাহর নোটপ্যাড বা ডায়েরি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি ইত্যাদি। 

বিশ্বব্যাংকের তদন্ত
অভিযোগ নিয়ে দুদকের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের প্রথম বিশেষজ্ঞ প্যানেলের বৈঠক হয় ২০১২ সালের ১৫-১৬ অক্টোবর। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের বৈঠক হয় ২০১২ সালের ২ থেকে ৫ ডিসেম্বর। তিন সদস্যের প্যানেলে ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সাবেক প্রধান আইনজীবী লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পো, হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক প্রধান টিমোথি টং ও যুক্তরাজ্যের রিচার্ড অ্যাল্ডারম্যান। তারা সৈয়দ আবুল হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন ২০১২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর।

বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় করেনি
বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা) ব্যয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা অনুমোদন করেছিল ২০১১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল একই বছরের ২৮ এপ্রিল। পরে বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় করেনি। এর পর শেখ হাসিনার সরকার নিজেদের অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ২২ মিটার সেতু নির্মাণে খরচ হয় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।

দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান যা বললেন
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান সমকালকে বলেন, প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরীর মতো স্বনামধন্য প্রকৌশলীর নেতৃত্বে পদ্মা সেতুর মূল্যায়ন কমিটি ছিল। এই কমিটি দীর্ঘ সময় কাজ করে এ প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো তথ্য পায়নি। কানাডার আদালতও দুর্নীতির প্রমাণ পাননি। এখন এই প্রকল্পের দুর্নীতি বের করতে চাইলে কতটুকু পাওয়া যাবে, তা বোধগম্য নয়। 

আইনজীবীর বক্তব্য
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সমকালকে বলেন, পদ্মা সেতু দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে বর্তমান কমিশনের কাছে যদি নতুন কোনো তথ্য আসে এবং সেই তথ্য যদি বিশ্বাসযোগ্য হয়, তাহলে নতুন করে অনুসন্ধান করতে আইনে কোনো বাধা নেই। এই পর্যায়ে দুদক যেসব তথ্য পেয়েছে, তা অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে।

আরও পড়ুন

×