ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি’ লিখে আন্দোলনে যায় আনাস

ছেলের সেই চিঠি ছুঁয়ে এখনও কাঁদেন মা

ছেলের সেই চিঠি ছুঁয়ে এখনও কাঁদেন মা

আজও সেই চিঠি ছুঁয়ে কাঁদেন শহীদ আনাসের মা সানজিদা খান দীপ্তি -সমকাল

 বকুল আহমেদ

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫ | ০১:১১

ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। চারদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলির শব্দ। ৫ আগস্ট সকালে রাজধানীর কেন্দ্রমুখী শত শত মিছিল। এমনই একটিতে ছিল স্কুলছাত্র শাহরিয়ার খান আনাস। বাবা-মায়ের বাধ্য ছেলে আগে থেকেই মুক্তির মিছিলে যেতে উদগ্রীব ছিল। কিন্তু ১৭ বছরের কিশোরকে এ অনুমতি কে দেবে? আনাস এতে থামল না। ভিন্ন এক পথ বেছে নিল। বাবা-মাকে লিখল আবেগঘন চিঠি– ‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি’। ভোরের আলো ফুটতেই যোগ দিল ছাত্র-জনতার স্রোতে। তারপর মুহুর্মুহু গুলি... ইতিহাস।

আনাস কি জানত– সে আর ফিরবে না? চিঠিতে লিখেছিল– ‘আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো।’ আজও সেই চিঠি ছুঁয়ে কাঁদেন শহীদ আনাসের মা সানজিদা খান দীপ্তি।
চিঠিটি লিখে ৫ আগস্ট সকালে রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেয় আনাস। সেখানেই পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয় তার বুক। স্বজন তার সেই চিঠির কথাগুলো পাথরে খোদাই করে ঘরে টানিয়ে রেখেছেন। সরেজমিন দেখা যায়, পুরো ড্রয়িংরুমের দেয়ালে আনাসের ছবি। বাবা-মা ও ছোট্ট দুই ভাইয়ের সঙ্গে এক ফ্রেমে তোলা তার ছবিগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। এ বয়সেই স্মৃতি হয়ে গেল আনাস! কথাটি বলতেই চোখে অশ্রু চলে আসে মা দীপ্তির। আঁচল দিয়ে ছেলের ছবিগুলো মুছতে শুরু করেন। ছবিতে ছেলের মুখে হাত রেখে কাঁদছিলেন তিনি। গত ৪ জুলাই সরেজমিন ওই বাসায় গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।

আনাসদের বাসা গেণ্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডে। সেখানে তার নামে ‘শহীদ শাহরিয়ার খান আনাস সড়ক’ উদ্বোধন করা হয়েছে। বাসায় গিয়ে কথা হয় তার বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ ও মা দীপ্তির সঙ্গে। ঢুকতেই ড্রয়িংরুমের দেয়ালে সাঁটানো আনাসের ছবিগুলো দেখে চোখ আটকে যায়। একটি ছবিতে এক ফ্রেমে হাস্যোজ্জ্বল তিন ভাই– আনাস, সাফওয়ান ও সুফিয়ান। সাফওয়ানের বয়স ৬ বছর, সুফিয়ানের ২। বাবা-মায়ের সঙ্গে যখন ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে কথা হচ্ছিল, তখন সাফওয়ান ও সুফিয়ান খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলছে। আনাস নাম শুনেই ছোট্ট সুফিয়ান বাবা পলাশের কাছে ছুটে এসে দেয়ালের ছবির দিকে হাত ইশারা করে ‘আনা (আনাস) ভাইয়া, আনা ভাইয়া’ বলে ওঠে।

স্বজন জানান, আন্দোলনে উত্তরায় মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের প্রাণ যায়। এর পর থেকেই আনাস আন্দোলনে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। কিন্তু পরিবারের সবাই তাকে বাধা দেন। বাবা-মায়ের খুব বাধ্য সন্তান ছিল সে। কিন্তু বাবা-মাকে বলত, আন্দোলনে যেভাবে গুলি করে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হচ্ছে, এটা দেখে ঘরে বসে থাকা যায় না। গুলি করে মানুষ হত্যা করা সরকারের কাজ না।
আনাসের বাবা পলাশ বলেন, ‘ফ্যাসিস্টদের ভয়ে আনাসকে আন্দোলনে যেতে বাধা দিয়েছিলাম। পরে আমিসহ আনাস আন্দোলনে যাব বলে তাকে মিথ্যা আশ্বাস দিতাম। ৪ আগস্ট রাত আড়াইটার দিকে সে বলে, বাবা, সকালে সবাই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হবে। চলো, আমরা যাই। কারফিউয়ের (জরুরি অবস্থা) মধ্যে বের হওয়া যাবে না জানিয়ে আমি শুয়ে পড়ি। সকালে ওর মা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে বলে– আনাস ঘরে নেই। একটি চিঠি টেবিলে রেখে আন্দোলনে চলে গেছে।’

দুপুর ১টার দিকে এক আন্দোলনকারী আনাসের বাবাকে ফোন করে জানতে চান– আন্দোলনে তাদের কেউ অংশ নিয়েছে কিনা। ছেলে আনাসের কথা জানালে ওই ব্যক্তি দ্রুত স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলেন। এর পরই স্ত্রী ও শ্বশুরকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যান পলাশ। জরুরি বিভাগের পাশে কাপড়ে ঢাকা গুলিবিদ্ধ আনাসের লাশ পান তারা।
৫ আগস্ট সকালে আন্দোলনকারীরা চানখাঁরপুল হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু চানখাঁরপুল মোড়ে পুলিশ অবস্থান নিয়ে তাদের প্রতিহত করতে দফায় দফায় গুলি চালায়। গুলিতে আনাসসহ ছয়জন নিহত হন। 

আরও পড়ুন

×