ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

শ্রদ্ধাঞ্জলি

বহুমাত্রিক শিল্পী

বহুমাত্রিক শিল্পী

ফাইল ছবি

রফিকুন নবী

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২০ | ১৫:২২

মুর্তজা বশীর আমাদের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলা বা শিল্পচর্চা এবং এ সংক্রান্ত ভাবনা-চিন্তা-দর্শনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তার মধ্যে মুর্তজা বশীর একজন। তিনি শুধু যে বড় চিত্রকর ছিলেন তাই নয়, তাকে সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করতে গেলে তার আরও অনেকগুলো কর্মকাণ্ডের কথা আমাদের স্মরণ করতে হবে। তিনি ছবি আঁকার পাশাপাশি চমৎকার লিখতেনও। এই গুণটা নিশ্চই তিনি তার স্বনামধন্য পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র কাছ থেকে পেয়েছিলেন। সাহিত্যে বেশকিছু অপূর্ব অবদান রয়েছে মুর্তজা বশীরের। তার উপন্যাস রয়েছে, তিনি কবিতা  লিখতেন, গদ্য লিখতেন, বলতেনও ভালো। বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলায় তিনি একেবারে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত চিত্রকলা চর্চা করে গেছেন। চারুকলায় শিক্ষকতা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানকার চারুকলা বিভাগের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। সবদিক মিলিয়ে আমাদের শিল্পকলা জগতে বিরাট একটা অবদান রয়েছে মুর্তজা বশীরের।

আমাদের শিল্পচর্চা জগতের ভিত্তিটি যারা তৈরি করে দিয়ে গেছেন, মুর্তজা বশীর ছিলেন তাদের একজন। তাদের মধ্য থেকে বলা যায় মুর্তজা বশীরই সবার শেষে চিরবিদায়ের পথে গেলেন। আমরা জানি, তার সমসাময়িক যারা ছিলেন, তারা সবাই চলে গেছেন আগেই। কাইয়ুম চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, রশীদ চৌধুরী প্রমুখ ছিলেন বশীর ভাইয়ের সহপাঠী।

বশীর ভাই দেশের চারুকলা শিক্ষা শেষ করে ফ্লোরেন্সে গিয়ে লেখাপড়া করেছেন। বিলাতেও ছিলেন। আন্তর্জাতিক শিল্পকলা অঙ্গন সম্বন্ধেও অসাধারণ জ্ঞান ধারণ করতেন তিনি। প্রবাসে তার সহপাঠী অনেকেও পরবর্তীতে বড় শিল্পীতে পরিণত হয়েছেন।

ছবি আঁকার বাইরে মুর্তজা বশীরের অন্য অনেক কাজ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো মুদ্রা সংগ্রহ। তিনি বিভিন্ন যুগের, বিভিন্ন দেশের কয়েন সংগ্রহ করতেন। এ নিয়ে লিখেছেনও। এ ধরনের বহু কাজ তিনি নিয়মিত এবং মনোযোগ দিয়ে করতেন।

পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তান হওয়ার পরে এখানে যখন জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদদের নেতৃত্বে আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা পেল- সেখানে শিল্পকলা শিক্ষায় তখনও কোনো ভূত নাই ভবিষ্যৎ নাই, ছবি এঁকে কে কী করবে! শিল্পী হয়ে এখানে কী হবে! কে পড়বে আর্ট কলেজে! এমনতর সব চিন্তা-ভাবনা। আমাদের এখানে তখনও সৃজনশীলতা শিক্ষার জগৎটা শূন্য। সবাই চলে যেত কলকাতায়। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর তেমন সব অনিশ্চয়তার ভাবনা মাথায় নিয়েই জয়নুল আবেদিনরা এখানে আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেন। সেখানে দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলেন মুর্তজা বশীর, রশীদ চৌধুরীরা। তাদের যারা অগ্রজ তারা তো আর্ট কলেজটা প্রতিষ্ঠা করলেন, কিন্তু তৎকালীন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে সব অনিশ্চয়তার বোঝা মাথায় নিয়ে আর্ট কলেজের ছাত্র হতে পারাটা একটা বিরাট দুঃসাহসী ব্যাপার ছিল। বশীর ভাইয়ের অনেক সুযোগ ছিল অন্য দিকে যাওয়ার। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র ছেলে হিসেবে পারিবারিকভাবেই শিক্ষাদীক্ষা ও সুযোগ-সুবিধায় বিবিধ সম্ভাবনা ছিল তার। বলা যায় চতুর্দিকটাই খোলা ছিল তার। যে কোনো লেখাপড়ার দিকেই যেতে পারতেন। ভালো ছাত্র হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। কিন্তু শিল্পকলার দিকে বিশেষ করে চিত্রকলায় নিয়োজিত হওয়ার প্রতি যে অগাধ আকাঙ্ক্ষা- সেটাকে প্রাধান্য দিয়েই তিনি আর্ট কলেজে ভর্তি হলেন। সেখানে সেরা ছাত্র হিসেবেও তিনি নাম করলেন এবং বিদেশে যাওয়ার সুযোগ অর্জন করে নিলেন। সে হিসেবে সব দিক মিলিয়ে বশীর ভাই ছিলেন একজন পরিপূর্ণ শিল্পীর উদাহরণ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, এমনকি শেষ দিকের এই অসুস্থ অবস্থায় তিনি শিল্পকলা নিয়ে ভেবেছেন, ছবি এঁকেছেন। অহরহ ছবি আঁকতেন মুর্তজা বশীর। শেষ দিকে তো সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে চলতে হতো তাকে। সেই অবস্থাতেও তিনি চর্চার মধ্যে ছিলেন। তার এই শিল্পচর্চার প্রতি স্পৃহাই শুধু আমাদের কাছে স্মরণীয় নয়, তার যাবতীয় কর্ম- চিত্রকর্ম, সংগ্রহ, গ্রন্থ যা কিছু আছে সেগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ আমাদের খুবই জরুরি দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। কারণ তা আমাদের জাতীয় সম্পদ। আমাদের শিল্পচর্চা জগতের পাথেয়। এই উপমহাদেশের অন্যতম একজন বড় শিল্পী মুর্তজা বশীর। সেই কথা মাথায় রেখে আমাদের অনেক কিছুই করণীয় আছে।

জীবনের একটা পরিণত সময়েই শিল্পী চলে গেলেন। তার এ চলে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে আমাদের শিল্পচর্চা জগতে একটা অপরিসীম শূন্যতার সূচনা করল। তিনি সমস্ত জীবনে অসংখ্য অসাধারণ কাজ করে গেছেন। আমাদের তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তার কাজগুলোকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে। জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমি ও এমন সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলো এ বিষয়ে নিশ্চই ভাববে।

আমরা আমাদের অন্যতম বড় শিল্পীকে হারালাম। আমাদের দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো যেন আর কেউ রইল না। এ শূন্যতা পূরণীয় নয়, কিন্তু আমরা জানি যে, শিল্পীদের কাজটাই বড়, তার সেই কাজগুলো থাকবে, তা দিয়েই আমরা তাকে স্মরণে রাখব। জীবনেও শিল্পের শিক্ষক ছিলেন, ভবিষ্যতেও শিক্ষকই থেকে যাবেন। তার কাজ দিয়ে, শিল্পের প্রতি তার জীবনব্যাপী অভিনিবেশের দৃষ্টান্ত দিয়ে।

আরও পড়ুন

×