প্রকল্প বাস্তবায়নে তবুও অপচয়

প্রতীকী ছবি
আবু হেনা মুহিব
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২০ | ১৪:৪৫
উন্নয়ন প্রকল্পে অপচয় রোধে সতর্ক থাকতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা থাকলেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। বিভিন্ন প্রকল্পে একের পর এক অপচয়ের খবর বেরিয়ে আসছে। ছোট-বড় বহু প্রকল্পে এমন কিছু কেনাকাটার ব্যয় দেখানো হচ্ছে, যা অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। যেমন করোনাকালে ৫০০ টাকার একটা নিরাপত্তা চশমা কেনার দাম দেখানো হচ্ছে পাঁচ হাজার টাকা। করোনাকালে ঘরে বসে জুম মিটিং করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানে আপ্যায়ন ব্যয় দেখানো হচ্ছে ৫৭ লাখ টাকা। একটি গাড়ি ভাড়ার পেছনে মাসিক ব্যয় দেখানো হচ্ছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র বলছে, কভিডের আঘাতে আয় কমেছে সরকারের। বিপরীতে বেড়েছে ব্যয়। কভিডের ক্ষতি থেকে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। রাজস্ব জোগানের লক্ষ্যমাত্রা অনেক পিছিয়ে আছে। অর্থের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে সরকার এডিপির বাইরে বাজেট সহায়তা হিসেবে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থা এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে সাহায্য চেয়েছে। ব্যয় সাশ্রয়ের চিন্তা থেকে অন্তত ৫০০ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।
গত ৮ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে উচ্চ, মধ্য এবং নিম্ন অগ্রাধিকার- এ তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এতে বলা হয়, এর মধ্যে শুধু উচ্চ অগ্রাধিকারের প্রকল্পগুলোর অর্থছাড় স্বাভাবিক থাকবে। খুব জরুরি না হলে মধ্য অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ স্থগিত থাকবে। নিম্ন অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্পের অর্থছাড় সম্পূর্ণই বন্ধ থাকবে।
এসব কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য হলো, কোনোভাবেই অর্থ অপচয় করা যাবে না। বরং ব্যয় সাশ্রয় করতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন প্রকল্প বিশ্নেষণ করে দেখা যাচ্ছে, অপচয় বন্ধ হচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সমকালকে বলেন, কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে একটু বাড়াবাড়ি হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে মানবিক ভুলের বাইরে ইচ্ছাকৃত বাড়াবাড়ি ক্ষমা করা হবে না। আগামীতে এ ধরনের অনিয়মের বিষয়ে আরও ভালোভাবে তদারক করা হবে। তিনি জানান, পরিকল্পনা কমিশনের শক্তি বাড়ানো হবে। কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হবে।
জুম মিটিংয়ে আপ্যায়ন ব্যয় ৫৭ লাখ টাকা: কভিডকালে লকডাউনের একপর্যায়ে ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে জুম মিটিংয়ে প্রয়োজনীয় অনেক কাজ সম্পন্ন করা হয়। এ ধরনের মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারীরা যে যার অবস্থান থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে মিটিংয়ে সংযুক্ত হন। এখানে কোনো ধরনের ব্যয়ের সুযোগ নেই। এরকম জুম মিটিংয়েও আপ্যায়ন বাবদ ব্যয় দেখিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও বাস্তবায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। কর্মশালা এবং সভার আপ্যায়ন বাবদ ৫৭ লাখ টাকার ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী সমকালকে বলেন, গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে আইএমইডির সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। জুম মিটিংয়ে আপ্যায়ন ব্যয় তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগের ঘটনা। তিনি জানান, অবাস্তব, অপ্রয়োজনীয় কোনো ব্যয় করা হবে না। সরকারি ব্যয়সহ আইএমডির সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্বে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। গত দুই মাসে কিছুটা গুণগত উত্তরণ সম্ভব হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।
৫০০ টাকার চশমা পাঁচ হাজার টাকা: 'করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জরুরি সহায়তা' নামের প্রকল্পে একটি নিরাপত্তা চশমার দাম ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। এক লাখ চশমা বাবদ মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। বাজারদর অনুযায়ী এ মানের একটি চশমার দাম সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা। স্বাভাবিক দর ৫০০ টাকা। একই প্রকল্পে একেকটি পিপিইর দাম ধরা হয়েছে চার হাজার ৭০০ টাকা। বাজারে পিপিই পিসপ্রতি দর সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা। সর্বনিম্ন ৫০০ টাকায়ও পিপিই পাওয়া যাচ্ছে। এক লাখ সাত হাজার ৬০০ পিস পিপিই কেনা বাবদ ৫০ কোটি ৫৭ লাখ টাকার ব্যয় অনুমোদন করা হয়েছে। এক হাজার ১১৭ কোটি টাকার এ প্রকল্পের বুট জুতাসহ অন্যসব কেনাকাটায় এরকম অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে।
ইলিশ রক্ষা প্রকল্প: প্রকল্পের নাম ইলিশ উন্নয়ন। জাটকা রক্ষার জন্য গৃহীত এ প্রকল্পে একটি গাড়ি ভাড়ার পেছনে প্রতি মাসে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ চার বছর। অর্থাৎ, পুরো মেয়াদে এক গাড়ির পেছনেই ব্যয় হবে সাড়ে ৫৭ লাখ টাকারও বেশি। অথচ এই মূল্যে নতুন গাড়ির মালিকই হতে পারত বাংলাদেশ। কিন্তু 'বিশেষ উদ্দেশ্য' মাথায় রেখে এই গাড়ি ভাড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
সূত্রমতে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত এই প্রকল্পটি এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক ভাবনা, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি), পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন (পিএসই) কমিটিও অনুমোদন দিয়েছে। সব শেষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকেও প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে।
বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প (এডিপি) বাস্তবায়নে ২৫৬ কোটি টাকার এ ইলিশ প্রকল্পের এক অঙ্গের ব্যয়ের চিত্র এটি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্নিষ্ট সচিব কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য জাকির হোসেন আকন্দ সমকালকে বলেন, 'এটি সাধারণ গাড়ি নয়। প্রকল্পের কাজে গ্রামাঞ্চলের যে কোনো রাস্তা বা জায়গায় চলাচলের উপযোগী গাড়ি এটি। তাই সাধারণ গাড়ির তুলনায় এর পেছনে ব্যয়ও একটু বেশি।'
সংশ্নিষ্টরা জানান, এডিপি বাস্তবায়নে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয়ের সমালোচনা এবং অপচয় চলছে একই সঙ্গে। অপচয় রোধে বিভিন্ন সময় দফায় দফায় অনুশাসন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি প্রকল্প যখন চূড়ান্ত হয়ে একনেকে আসে, সেখানে চুলচেরা বিশ্নেষণ করা সম্ভব হয় না। এর আগেই প্রকল্পের কোনো খাতে অপচয় থাকলে তা রোধ করতে হবে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি একনেক বৈঠকে প্রকল্পের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, এরকম একটি ডাকবাংলো নির্মাণের প্রস্তাব নিজ হাতে কেটে দেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের নির্মাণকাজ পরিদর্শনে যাওয়া কর্মকর্তাদের অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে বিলাসবহুল এ ডাকবাংলো নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটিও ডাকবাংলোটি নির্মাণে আপত্তি জানায়নি। কিন্তু একনেকে যাওয়ার আগেই এসব প্রকল্পে কোনো খাতে অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়ে থাকলে তা বন্ধ করা উচিত। কারণ একনেক বৈঠকে বসে প্রকল্পের খুঁটিনাটি দেখা সম্ভব নয়।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, কভিডে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ব্যয় সংকোচনের সরকারি নীতির মধ্যেও এ ধরনের অপব্যয় চলছেই। বিভিন্ন প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় হলেও প্রশিক্ষণের নামে দলবেঁধে বিদেশ সফরের খাতে প্রচুর অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব থাকছে। দৃষ্টিকটু হওয়ার পরও এগুলো যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়ছে না। খিচুড়ি রান্না ও পরিবেশন করা এবং ট্যাংরা-পুঁটির চাষ দেখতে বিদেশ সফরের ঘটনা নিয়ে অনেক সমালোচনা এরই মধ্যে হয়েছে। পরামর্শক ফির পেছনে প্রকল্পের অর্ধেক ব্যয় কিংবা ছোট প্রয়োজনে বড় ব্যয়ের মতো চিন্তাও বাদ যাচ্ছে না।
এ ছাড়া কম গুরুত্বপূর্ণ নতুন নতুন প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। কভিডের মধ্যেই শামুক-ঝিনুক উন্নয়নের মতো প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে, যা সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির সঙ্গে একেবারেই সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কভিডের মধ্যেই চলতি অর্থবছরের গত জুলাই থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একনেকে মোট ৬২টি নতুন প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। এসব প্রকল্পে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। জানতে চাইলে পরিকল্পনা সচিব মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, নতুন প্রকল্পের জন্য অর্থপ্রাপ্তি কোনো সমস্যা হবে না। তবে বাস্তবায়নে একটু বেশি সময় লাগতে পারে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে কেনাকাটায় অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। ৩০টি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালকদের নিয়ে সম্প্রতি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। এতে মুখ্য আলোচ্য বিষয় ছিল প্রকল্পের কেনাকাটার অতিরিক্ত ব্যয় এবং অপচয় রোধ করা। বৈঠকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নাধীন কয়েকটি প্রকল্পের কেনাকাটাসহ বিভিন্ন অনিয়ম তদন্তে টাস্কফোর্স গঠন করার কথা জানানো হয়। টাস্কফোর্স তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, প্রকল্প প্রস্তাব যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই ছাড়া পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো যাবে না। একনেকে অনুমোদনের সুপারিশের আগে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রকল্পে ব্যয়ের বিভিন্ন খাত যাচাই-বাছাই করতে হবে।
অপব্যয় নিয়ন্ত্রণে সরকারের ৬ দফা নির্দেশনা: এডিপিতে অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি ছয় দফা বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এতে বলা হয়, কোনো পণ্য এবং দ্রব্য ক্রয়ে যাতে অস্বাভাবিক মূল্য প্রদর্শিত না হয়। প্রকল্প যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা নেওয়ার কথা বলা হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং সচিবদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এই নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে গত মাসে। ব্যয় নিয়ন্ত্রণে চিঠিতে আরও বলা হয়, জিটুজি বা সরকার পর্যায়ের প্রকল্পে সরকারের অর্থে পরামর্শক নিয়োগের ব্যবস্থা রাখতে হবে। মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর (এমটিবিএফ) আওতায় অর্থবছরের বরাদ্দ করা ব্যয় সীমার মধ্যেই রাখতে হবে। রাষ্ট্রীয় এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিশেষ প্রকল্পে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হলে আগে থেকেই অর্থ বিভাগের অনুমতি নিতে হবে। এ ছাড়া বিনিয়োগ প্রকল্পের ব্যয় ৫০ কোটি টাকার বেশি হলে আবশ্যিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির (আরএডিপি) আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। বরাদ্দসহ অনুমোদিত প্রকল্পের সংখ্যা এক হাজার ৬৭৭টি। কভিডের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি বেশ ভালো।
- বিষয় :
- প্রকল্প বাস্তবায়ন
- অপচয়
- করোনাকাল
- অপ্রয়োজনীয় ব্যয়